‘আমি তোমার সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারি। কিন্তু তোমার মতপ্রকাশের অধিকারের নিশ্চয়তার জন্য আমি আমার প্রাণটা দিতেও কুণ্ঠিত বোধ করব না’। কথাটি বলেছেন দার্শনিক ভলতেয়ার। তিনি বক্তব্যে মূলত দ্বিমতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান প্রনয়নে কিছু দফা আপত্তিকর মনে হওয়ায় দ্বিমত পোষণ করেছিলেন সংবিধান প্রনয়ন কমিটির কনিষ্ঠ সদস্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রয়াত বাবু সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত। তখন অবশ্য তিনি আওয়ামী লীগ কেউ ছিলেন না। তার দ্বিমতকে সংবিধান প্রনয়ন কমিটি গুরুত্ব দিয়েছিল কিনা দেয় নাই সেই বিতর্কে যাব না। শুধু এতটুকু বলব পর্বতসম জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ সরকারের প্রণীত সংবিধানে তিনি যে দ্বিমত পোষণ করতে পেরেছিলেন সেটাই বা কম কিসে। আজকের বাস্তবতায় চিন্তা করলে তা অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু তখন সম্ভব ছিল। কারণ সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ নাগরিকের দ্বিমত পোষণ করার স্বাধীনতাও অর্জন করেছিল।
রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্বিমত পোষণ করার ক্ষেত্র ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে গেছে। এর জন্য অবশ্য রাজনৈতিক সরকার দায়ী নয়। দায়ী সাধারণ মানুষ। স্বৈরশাসকের কথা না হয় বাদ দিলাম। কারণ তাদের কোনো জনভিত্তি থাকে না। ফলে জনগণের প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতাও থাকে না। বিগত ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণ তাদের পছন্দের দলকে এত পরিমাণ ভোট দিয়েছিল যে, তারা দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। অতিরিক্ত ভোটদানের ফলে কি হয়? দুই তৃতীয়াংশের বেশি আসনপ্রাপ্ত দলীয় সরকারকে সংসদে আর কারও কাছে জবাবদিহিতা করতে হয় না। ফলে জনআকাক্সক্ষা সংকুচিত হয় ও স্বৈরাচারী শাসন কায়েম হয়। সংসদে সরকারি দলের কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশের সুযোগ নেই বললেই চলে। কারণ তাদের দ্বিমতকে গুরুত্ব দেয়া হয় না। অথচ সংসদে বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যের নেতিবাচক সমালোচনার মাধ্যমে উত্থাপিত প্রস্তাব পরিশুদ্ধ হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বিমত পোষণ করে ঘাড়ে মাথা রাখাই চ্যালেঞ্জ। দ্বিমত পোষণকারীর নিরাপত্তা দ্বিমত পোষণ করার ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়। গণতান্ত্রিক ভিত যত দুর্বল হবে দ্বিমত পোষণের মাত্রা তত হ্রাস পাবে। কেননা গণতন্ত্রই মূলত দ্বিমত। দ্বিমতই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। গণতন্ত্র শক্তিশালী না থাকলে দ্বিমত সেখানে টিকে না। তাই দ্বিমত প্রথাকে টেকসই ও স্থায়ী রূপ দিতে হলে আগে গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে হবে। রাষ্ট্রের সর্বস্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। অপরের কথা শ্রবণ করা, এমনকি যদি সে শত্রু হয় কিংবা ভিন্নমতাবলম্বীও হয় তবুও তাকে কথা বলতে দিতে হবে। তার কথা শুনতে হবে। সবশেষে দ্বিমত পোষণকারীর কথা যদি যৌক্তিক হয় তবে তা মানতেও হবে। সংখ্যার বিচারে দ্বিমতকে খারিজ করে দেয়াও এক প্রকারের স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা আমরা প্রতিনিয়ত শুনে আসছি। কিন্তু দ্বিমত পোষণের স্বাধীনতার কথা সেভাবে শুনি না বা শুনতেও চাই না। অথচ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চেয়ে দ্বিমত পোষণের স্বাধীনতা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দ্বিমত পোষণ করতে না পারলে চিন্তা ও মতপ্রকাশের অর্ধাংশ অপ্রকাশিত থেকে যায়। একপেশে মতপ্রকাশ চিন্তার ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে। ফলে ও উদ্ভাবনী চিন্তা ও মেধাশক্তি হ্রাস পায়। স্বাধীন মতপ্রকাশ যেমন জনমনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনে তেমনই দ্বিমত প্রকাশের স্বাধীনতা চিন্তার জগৎটাই বদলে দেয়। গণতান্ত্রিক চৌহদ্দিতে দ্বিমতের গুরুত্ব অত্যবশকীয়।
একটি বিষয়ে কেউ একজন দ্বিমত পোষণ করবে না, সকলেই একমত হবে, এরকম প্রত্যাশা সমীচীন নয়। এটি জবরদস্তি মূলক চিন্তার প্রতিফলন। দ্বিমতকে গোনায় ধরা মূলত গণতন্ত্রের উৎকর্ষের প্রামাণক। একটি দেশ ও সমাজ কতটুকু গনতান্ত্রিক তা নির্ভর করে দেশটি বা সমাজটি দ্বিমতকে কতটুকু প্রাধান্য দিচ্ছে তার উপর। হামবড়া মনোভাব দ্বিমতের ক্ষেত্রকে সংকুচিত করে। আমিতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রকে বাজারজাত করে। একক মতে রাজতন্ত্রের ছায়া লুকায়িত। রাজ্যের সকল প্রজা যদি রাজার শাহী ফরমানকে বিনাবাক্যে মেনে নেয় তাহলে বুঝতে হবে সে রাজ্যের রাজা অত্যাচারী স্বৈরাচার।
গণতন্ত্রের সৌন্দর্য বিকশিত হয় দ্বিমতকে প্রাধান্য দানের মাধ্যমে। দ্বিমত শ্রবণের মাধ্যমেই কেবল একটি বিষয়ের ঋণাত্মক দিক সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া যায়। ঋণাত্মক বিষয়ে ওয়াকিবহাল না হলে সেই সিদ্ধান্ত দীর্ঘ মেয়াদে ফলপ্রসূ হয় না। কিছু সময়ের জন্য কার্যকর মনে হলেও বাস্তবিক অর্থে তা অসারতাই প্রমাণ করে। এর ফলে রাষ্ট্রের সকল স্তরে জ্বি হুজুর নামক স্তুতি প্রাধান্য পায়। করদ রাজ্যের রাজা, মন্ত্রী,দফাদার, পাইক, পেয়াদা সকলেই দ্বিমতকে পথের কাটা মনে করে। দ্বিমত পোষণকারীকে শত্রু জ্ঞান করে তার চৌদ্দ গুষ্টির ষষ্ঠী করে ছাড়ে। অথচ তারা একবারও আমলে নেয়না যে দ্বিমত তাদের দ্বি-পথ তৈরি করে আরও স্পষ্ট করে বললে বিকল্প পথ তৈরিতে সহায়তা করে। বিকল্প পথহীন কোনো গুরুত্বপূর্ণ মত বা প্রস্তাবনা ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বাংলাদেশে এনজিওগুলোতে একটি গল্প প্রচলিত আছে। তারা নতুন কোনো প্রকল্প হাতে নেয়ার পূর্বে তার সম্ভবতা যাচাই করার জন্য উš§ুক্ত আলোচনার আয়োজন করে। সভায় প্রকল্প উত্থাপনকারী সূচনা বক্তব্যে প্রকল্পের পজিটিভ দিকগুলো উপস্থাপন করে বাকি বক্তাদের এই বার্তা দেয় যে, প্রকল্পের পজিটিভ দিকগুলো বুঝেই তারা প্রকল্প নিয়ে সামনে এগোতে চাচ্ছে। উপস্থিত বক্তাকে উত্থিত প্রকল্প সম্পর্কে বাধ্যতামূলকভাবে দ্বিমত পোষণ করতে হবে। এতে কি হয়! সম্ভব্য প্রকল্পটিতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। প্রকল্পের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। কথিত আছে ব্রাকের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্যার ডক্টর ফজলে হাসান আবেদ ব্রাকের শুরুর সময়ে প্রকল্পের সম্ভবতা যাচাই না করে উপকূলীয় অঞ্চলে বৃক্ষরোপণ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। ফলে অতি বন্যায় পুরো প্রকল্প ব্যর্থতায় পর্যবাসিত হয়।
ভিন্নমত দমন দ্বিমত পোষণের স্বাধীনতার অন্যতম অন্তরায়। ভিন্নমতকে সহ্য করতে না পারা, ভিন্নমতের প্রতি সহনশীল না হওয়া, একটি অসুস্থ সমাজের ইঙ্গিত বহন করে। সমাজের সর্বস্তরে সকলের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে দ্বিমত প্রকাশে ভিন্নমতকে প্রাধান্য দিতে হবে। দার্শনিক সক্রেটিস স্বেচ্ছায় হেমলক পান করে নিজের উপর রাষ্ট্রের প্রহসনের বিচার কার্যকর করেছিলেন। তবুও নিজের মতবাদ থেকে সরে আসেননি। যেগুলো রাষ্ট্রের কাছে দ্বিমত হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। তিনি চাইলে নিজের মতবাদ প্রত্যাহার করে নিজেকে বাঁচাতে পারতেন। তা করেননি বলেই আজ তিনি সক্রেটিস। ‘আই হ্যাভ এ ড্রিম’ খ্যাত স্বপ্নের ফেরিওয়ালা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কালো মানুষের অধিকার আদায়ের নেতা মার্টিন লুথার কিং বলেন ‘যে কথা আপনি ইতোমধ্যেই বলে ফেলেছেন শুধু সেই কথার জন্য আপনি দায়ী নন, আপনি যে কথা বলেননি তার জন্যও আপনি দায়ী। আলোচনান্তে ধরে নিচ্ছি মিস্টার কিংয়ের না বলা কথাটিই হয়তো দ্বিমত। যা বলতে না পারায় নিজেকে দায়ী মনে করেছেন।’ শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ডেসমন্ড টুটু বলেন, ‘ক্রান্তিকালে আপনি কথা বলছেন না মানে আপনি শোষকের পক্ষে’। অথচ শ্রদ্ধেয় টুটু হয়তো জানেনই না যে পৃথিবীর অনেক দেশেই কথা না বলাকেই মানুষ নিরাপদ অস্ত্র বলে মনে করছে। বর্তমান আন্তর্র্বর্তীকালিন সরকার প্রধান শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পূর্ণ ব্যক্তি। যিনি হয়তো মনেপ্রাণে মত ও দ্বিমত পোষণের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। তিনি চাইলে রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে মতপ্রকাশের পাশাপাশি দ্বিমত পোষণের অবারিত স্বাধীনতার অংশীজন করতে পারেন। তাতে গণতন্ত্র আরও টেকসই ও সুসংহত হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মানবকণ্ঠ/আরএইচটি
Comments