Image description

বিভিন্ন কারণে একসময়ে যশোর জেলার কেশবপুরে এবং চুয়াডাঙ্গায় বিরল প্রজাতির কালোমুখো হনুমান আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। অনেকে এই হনুমানকে ‘চশমা চোখা’ বলে থাকে। কারণ এদের কালো চোখ দেখলে মনে হয় চোখে সানগ্লাস পরা আছে। সরকারী পর্য্যাপ্ত খ্যাদ্য সরবরাহ না থাকায় খাদ্যের অন্বেষণেই এরা এখন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে। অথচ হনুমান মূলত সংঘবদ্ধ প্রাণী হিসাবে পরিচিত। এরা এতটাই সংঘবদ্ধ যে, এদের একজনকে কেউ আঘাত করলে দলবদ্ধভাবে এরা তার প্রতিশোধ নিয়ে থাকে। এর প্রমাণও রয়েছে। 

একটি বাচ্চা হনুমান যশোর-সাতক্ষীরা সড়ক লাফ দিয়ে পার হতে গিয়ে দ্রুতগামী বাসের নিচে পড়ে মৃত্যু হয়। মুহূর্তের মধ্যে শতাধিক হনুমান মৃত হনুমানকে ঘিরে রাস্তা অবরোধ করে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আকার ঈঙ্গিতে হত্যাকারীর বিচারের আশ্বাসের পর সেই অবরোধ উঠিয়ে নেয়। এছাড়া ব্রহ্মকাটী গ্রামের এক ব্যক্তি তার বেগুনের ক্ষেত হনুমানের উপদ্রব থেকে রক্ষা করার জন্য তারের বেড়া বিদ্যুতায়িত করে রাখে। বিদ্যুতায়িত হয়ে একটি বাচ্চা হনুমান মারা যায়। এর প্রতিশোধ নিতে পরদিন রাতে দলবদ্ধভাবে হনুমানের দল গিয়ে পুরো ক্ষেতের সমস্ত বেগুন গাছ উপড়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। খাদ্যাভাব ছাড়াও নগরায়ণের কারণে বন জঙ্গলের বিলুপ্তিও এদের খাদ্য সংকটের আরেক কারণ। হনুমান সাধারণত ফলমূল খেয়েই জীবনধারণ করে থাকে। কিন্তু এখন তারা বাধ্য হয়ে বাড়িঘর এবং বাজারের দোকান থেকে রুটি বিস্কুট কলা এমনকি পথচারীর হাত থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে ক্ষুন্নি বৃত্তি নিবারণ করছে। 

নৃতত্ত্ব বিদদের মতে প্রায় চার কোটি বছর আগে হনুমান প্রজাতির জন্ম। কিন্তু কালের আবর্তে পৃথিবী থেকে যেসব প্রজাতি বিলীন হবার পথে এই তালিকার মধ্যে হনুমান অন্যতম। ভারত সরকার অবশ্য উড়িষ্যার কালোমুখো হনুমানগুলোকে যতœআত্তি করে রাখে। কারণ সনাতন ধর্মাবলম্বীরা রাম ভক্ত হনুমানকে দেবতা হিসাবে গণ্য করে। সারবিশ্বের কোথাও কালোমুখো বা চশমা চোখা এ হনুমানের অস্তিত্ব নেই। ভারত এবং বাংলাদেশের এই তিন জায়গা ছাড়া। 

মনে হয় এই প্রজাতি আমাদের গর্ব। আমরা একটু যত্নবান হয়ে এদের বংশবৃদ্ধি  করাতে পারলে হয়ত এদের আকর্ষণ আরও বেড়ে যাবে বিশ্ববাসীর কাছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য সরকারের হাতি সম একটি দপ্তরও আছে। কিন্তু তা শুধু কেতাবেই, গোয়লে নেই। এই দপ্তরটি হয়তো এদের কোনো খবরও রাখে না। অথচ সরকার বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে পুশছে এই হাতির পাল।

হনুমানের প্রজনন সাধারণত এপ্রিল-মে মাসে বেশি দেখা যায়। সারা বছর এ প্রক্রিয়া থাকে। এদের মাসিক চক্র ২৪ দিন। বাচ্চা হারিয়ে গেলে বা মারা গেলে আট দিনের মধ্যে এ চক্র শুরু হয়। ওদের গর্ভকাল ১৯০ থেকে ২১০ দিন। প্রতিবার স্ত্রী হনুমান একটি করে বাচ্চা প্রসব করে থাকে। প্রসবের পর বচ্চাটা এক বছর পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করে। পুরুষ হনুমান ছয়/সাত বছরে এবং স্ত্রী হনুমান ৩/৪ বছরে পরিপক্বতা লাভ করে থাকে। সব সময় পুরুষ হনুমানই এদের দলের নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। আর এ কারণেই পুরুষ বাচ্চা জন্ম নিলে দলপতি টের পেলেই তাকে হত্যা করে। যে কারণে পুরুষ হনুমান জন্ম নিলে তাকে নিয়ে দীর্ঘদিন মা হনুমান অন্যত্র চলে যায়।

এক সময় গাছে প্রচুর খাবার ছিল হনুমানের। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এসব খাবারের দিক থেকে। বন বিভাগের মাধ্যমে সরকারিভাবে অপ্রতুল খাদ্য সরবরাহ করা হয় এদের মাঝে। বর্তমানে প্রতিদিন ৪০ কেজি কলা আড়াই কেজি বাদাম এবং আড়াই কেজি পাউরুটি দেয়া হচ্ছে এই শতাধিক হনুমানকে। এই প্রজাতি রক্ষায় এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অভয়ারণ্য। যেখানে এরা স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারবে। আর এ ব্যবস্থা না হলে অচিরেই কালোমুখ বিরল প্রজাতির হনুমানের বিলুপ্তি ঘটবে নিঃসন্দেহে। সনাতন শাস্ত্রমতে রামভক্ত হনুমান। যাদের বীরত্বে শ্রীরামকৃষ্ণ বিশাল সাগর পাড়ি দিয়ে ‘লঙ্কা’ জয় করেছিলেন। 

বিলুপ্ত প্রায় এই কালোমুখো হনুমানের অস্তিত্ব এখনও আছে বাংলাদেশের কেশবপুর এবং চুয়াডাঙ্গায়। আর ভারতের উড়িষ্যা প্রদেশের লংড়– থানায়। যেটুকু অস্তিত্ব তাদের আছে, অনেক সংকট আর প্রতিকূলতার মাঝে তারা ধরে রেখেছে। দলবদ্ধভাবে বাসকারী এই প্রজাতি খাদ্য সংকটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে যত্রতত্র। হামলা চালাচ্ছে বসতবাড়ি এবং দোকানপাটে। তবুও খাদ্যের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে ব্যর্থ। ১৯৮৫ সালে এক সরকারি জরীপে কেশবপুর উপজেলায় তিন হাজার এবং চুয়াডাঙ্গার পাঁচ শতাধিক এবং উড়িষ্যায় সাড়ে চার হাজার হনুমান ছিল। তখন থেকে সরকারিভাবে কিছু আহারের সংস্থান এদের হয়েছিল বন বিভাগের মাধ্যমে। খাবার তালিকায় ছিল কলা, পাউরুটি এবং বাদাম জাতীয় খাদ্য। কিন্তু তাও এখন বন্ধ হয়ে গেছে। এখন কেশবপুরে একশ হনুমানও নেই। সেই সময় জরীপ দল এদের বংশবৃদ্ধির জন্য একটি অভয়ারণ্য করার সুপারিশ করেছিল। উপজেলা প্রশাসনও ব্যাপক তোড়জোড় করে ত্রিশ একর জমির উপর এই অভয়ারণ্যের জন্য নির্ধারণ করেছিলেন। কিন্তু আলোর মুখ দেখেনি আজও। স্তন্যপায়ী এই প্রাণীর নিরিবিলি প্রজনন ব্যবস্থা এবং এদের আহায্য ফলমূল অত্যাবশ্যক। 

স্ত্রী হনুমানের গর্ভকালীন সময় ১৯০ থেকে ২১০ দিন। একটি করে সন্তান প্রসাব করে এরা। উপযুক্ত প্রজননের ব্যবস্থা না থাকায় বংশবৃদ্ধি হচ্ছে না এদের। দ্রুত বিলুপ্ত হতে চলেছে বিরল এই প্রজাতিটি। এদের প্রজনন প্রক্রিয়া মানুষের মতো। এরা সাধারণত মাটিতে মিলিত হয়ে থাকে। তবে ক্ষেত্র বিশেষ গাছের উপর মিলন প্রক্রিয়া করে থাকে। 

অযত্ন ও অবহেলায় বিশ্বের অনেক প্রজাতির অস্তিত্ব আজ বিলীন। বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক আগেই। অথচ একটু সরকারি উদ্যোগ থাকলেই এই প্রজাতিটিকে বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো। আর এ জন্য প্রয়োজন অভয়ারণ্য। সেখানে এদের থাকবে না কোনো ভয়, খাদ্যাভাব এবং নিরিবিলি পরিবেশে থাকা ও প্রজননের ব্যবস্থা।

লেখক: কলামিস্ট

মানবকণ্ঠ/আরএইচটি