আত্মহত্যা একটি জটিল ও বহুস্তরীয় সমস্যা, যা মানসিক স্বাস্থ্য, সামাজিক প্রভাব এবং ব্যক্তিগত সংকটের সংমিশ্রণ। এটি শুধুমাত্র মানসিক রোগ বা শুধুমাত্র সামাজিক দায় দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না; বরং উভয় কারণই এতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কেউ ঘরে কিংবা হাসপাতালে রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে বাঁচার জন্য আপ্রাণ প্রার্থনা করে যাচ্ছে, আবার কেউ স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। দুটিই কষ্টের, তবে প্রেক্ষাপটটা ভিন্ন। কারো কষ্টটা শারীরিক আর কারো মানসিক। শারীরিক কষ্টের কাছে কখনো কখনো আমরা হেরে যাই এটা প্রাকৃতিক, কিন্তু মানসিক সমস্যার কারণ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক।
তবে এই সমস্যা হাজারো জীবন সংহার করছে সারা দুনিয়ায়।
সারা পৃথিবীতে প্রতিদিন এক হাজার ৯০০-র বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। আর এর মধ্যে দেড় হাজার অভাগা কিংবা অভাগীরই বাস নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। বাংলাদেশ এই তালিকায় অন্যতম দেশ, যে কি না স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশের তালিকায় ওঠার অপেক্ষায় আছে।
বাংলাদেশেও আত্মহত্যা নামক সামাজিক রোগ ও মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা একটি বড় সমস্যা।
‘আত্মহত্যা’ বিষয়টির সংখ্যাতাত্তি¡ক বিশ্লেষণের বাইরে গিয়ে সংবেদনশীলতা নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায়, মানসিক সমস্যা জয় করতে পারলে আত্মহত্যায় জীবননাশের ঝুঁকিও জয় করা সম্ভব। যারা মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, তাদের পারিবারিক ও সামাজিক সক্রিয় ও সার্বক্ষণিক সহায়তা খুবই জরুরি। যারা মানসিক সমস্যায় আছেন, যারা ভাবছেন এই সমাজ কী বলবে? তাদের বলছি, একবার ভেবে দেখুন এই সমাজ আপনাকে খাওয়ায় না পরায় যে সমাজের কথা ভেবে নিজেকে শেষ করে দেবেন।
আর মা-বাবা? তাদের সঙ্গে শুধু ভালোভাবে কথা বলুন। বিশ্বাস করুন, আর কিচ্ছু চাই না তাদের। আর আপনি যার জন্য মারা যেতে চাচ্ছেন, শুধু ভাবুন, তার মতো বা তার চেয়ে খারাপ বা তার চেয়ে ভালো মানুষ এ দুনিয়ায় অঢেল নয় কি? শুধু একটু মানিয়ে নেয়ার মনোভাব। ব্যস, আপনি আপাতদৃষ্টিতে সফল। এই সফলতাই পরবর্তী সময়ে স্থায়ী রূপ ধারণ করবে। আর ক্যারিয়ার? বিসিএসই কি ক্যারিয়ারের মাপকাঠি?
একবার ভাবুন তো বিসিএসে মোট কয়টা আসন? বিসিএস ছাড়া সমাজে সবাই কি মরে গিয়েছে? কিছু একটা দিয়ে শুরু করুন। তারপর বিভিন্ন ট্রেনিং করুন। তারপর বুঝেশুনে চাকরি পরিবর্তন করুন। জীবন অনেক মূল্যবান। অন্যের জন্য নিজেকে কেন শেষ করবেন? ক্ষমা করতে শিখুন, উদার হোন; আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যকে সাহায্য করুন। মাঝেমধ্যে নদীর ধারে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করুন।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশের ১৮ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক রোগে ভুগছে। শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অসচেতনতা এবং বিশেষ মুহূর্তে তাদের চাহিদা ও প্রবণতার প্রতি বেখেয়াল থাকার কারণে কারও কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা সৃষ্টি হতে পারে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত শতকরা ১৮ ভাগ শিশু-কিশোরের কর্মদক্ষতা (পাঠাভ্যাসে অমনোযাগী) কমে যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত দিয়েছেন।
শিশু-কিশোরদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা প্রতিরোধে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য, সৃজনশীলতা এবং পাঠ্যদক্ষতা বৃদ্ধির প্রতি লক্ষ্য রেখে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া বিশেষ জরুরি বলে বিবেচ্য। পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় মানুষের জাগতিক চিন্তা-চেতনায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে চলেছে। মানুষের ভাবনার সময় সীমা কমে আসছে। স্বল্প সময়ের সিদ্ধান্তে অনেকে সফল হচ্ছে আবার অনেকে বিপথে চলে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ইউটিউবের প্রতি কিশোর-তরুণদের আসক্তি এই প্রজন্মের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা, অবাস্তব কল্পনা, হতাশা ও আত্মহত্যা প্রবণতা যথেচ্ছভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে।
শুধু তাই নয়, ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়া কিছু গেম (যেমন ব্ল্যাক হোয়েল) এবং অ্যাপসে কিশোর-কিশোরীদের সরাসরি আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করতেও দেখা গেছে। প্রযুক্তির আগ্রাসন নিরসনে তাদের সাবধান করা হলেও মনস্তাত্ত্বিক কু-প্ররোচনায় প্রাণ দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। অনেকে আত্মহত্যার আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্টও দিয়ে থাকে, ‘হয়তো এটাই আমার শেষ পোস্ট।’ আত্মহত্যার আগে অনেকে লাইভেও আসে। আর এ ধরনের বিষয়গুলো কিছু অসামাজিক চলচ্চিত্র, শর্টফিল্ম শিক্ষার্থীদের মানসিকতাকে দুর্বল করে তুলেছে।
এসব সমাজবিরোধী ভিডিও ইন্টারনেটে তাদের সামনে আসছে যার শেষ পরিণতি তুচ্ছ বিষয়েও শিক্ষার্থী, তরুণ-তরুণীদের নির্মমভাবে আত্মহত্যা। কিশোর-তরুণ, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রবণতা হ্রাসকরণে ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বিষয়টি কয়েকটি কারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করছে। এই আত্মহত্যাকে সামগ্রিকভাবে প্রতিরোধে পাঠ্যসূচিতে ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষার উপস্থিতি, পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ়করণ, সামাজিক সম্প্রীতি ও মেলবন্ধনের ক্ষেত্রগুলো সম্প্রসারিত করতে হবে।
আত্মহত্যা কোনো গন্তব্য নয়; বরং নিজেকে জানা, বোঝা এবং ইতিবাচক চিন্তার মাধ্যমে এখানে লাগাতার উন্নতি সম্ভব। আত্মহত্যাকে শুধুমাত্র মানসিক রোগ কিংবা শুধুমাত্র সামাজিক দায় হিসেবে দেখা ঠিক নয়। এটি একটি বহুমুখী সমস্যা, যার সমাধানে পরিবার, সমাজ ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একসঙ্গে কাজ করা জরুরি। সচেতনতা বৃদ্ধি, মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করা, সহমর্মিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলা এবং সংকটে থাকা ব্যক্তিদের পাশে দাঁড়ানো আত্মহত্যা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী
Comments