
থিসিস জালিয়াতির অভিযোগে ছাত্রত্ব বাতিল হওয়ার ১০ বছর ৬ মাস পর ছাত্রত্ব ফিরে পেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম। রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁর ছাত্রত্ব পুনর্বহাল এবং মাস্টার্স পরীক্ষার অপ্রকাশিত ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক প্রফেসর মো. আখতার হোসেন মজুমদার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখে অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের ৫৩৬তম সভায় এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিন্ডিকেটের গঠিত রিভিউ কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রফিকুল ইসলামের মাস্টার্স রেজিস্ট্রেশন বাতিলের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।
জানা যায়, রফিকুল ইসলাম ২০০৮ সালে প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে উত্তীর্ণ হন। তবে এই ভালো ফলাফল তার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। শিবির সন্দেহে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে ফলিত গণিত বিভাগ থেকে তুলে নিয়ে পুলিশের হাতে সোপর্দ করেন। এরপর রফিকুলকে ৪ মাস ৭ দিন কারাগারে থাকতে হয়। জেলখানায় থেকেই দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষায় অংশ নিয়ে আবারও প্রথম স্থান অর্জন করেন রফিকুল। এভাবেই প্রতিকূল পরিস্থিতি অতিক্রম করে তিনি অনার্সে সিজিপিএ ৩.৮০ পেয়ে বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করেন।
তার স্বপ্ন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হতে দেননি বিভাগের তিনজন শিক্ষক। তারা মাস্টার্সের থিসিস জালিয়াতির অভিযোগ এনে তার ছাত্রত্ব বাতিল করেন এবং প্রায় ১০ বছরেও তার মাস্টার্সের ফলাফল প্রকাশ করা হয়নি।
২০১৪ সালে বিভাগের তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক ড. শামসুল আলম সরকারের অধীনে মাস্টার্সের থিসিস নেন রফিকুল। একই বছরের ১১ আগস্ট বিভাগে দুইজন প্রভাষক চেয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মাস্টার্সের ফলাফল প্রকাশ না হওয়ায় রফিকুল পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সার্টিফিকেট দেখিয়ে নিয়োগে আবেদন করেন। তবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে মাস্টার্সের সনদ দেখানো বাধ্যতামূলক হওয়ায় তিনি সেটি দেখাতে ব্যর্থ হন।
এরপর রফিকুলের থিসিস সুপারভাইজার অধ্যাপক ড. মো. শামসুল আলম সরকারের বিরুদ্ধে সিলগালা প্যাকেট খুলে নম্বরপত্র টেম্পারিংয়ের অভিযোগ এনে লিখিত অভিযোগ দেন বিভাগের শিক্ষক ড. আব্দুল হক। এ অভিযোগের ভিত্তিতে রফিকুলের ফলাফল প্রকাশ স্থগিত করা হয়।
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর জানায়, বিভাগের আটজন শিক্ষক ফলাফল প্রকাশের পক্ষে ছিলেন, কিন্তু অধ্যাপক ড. মো. আলি আকবর ও অধ্যাপক ড. মো. আশরাফুজ্জামান খান ফলাফল প্রকাশে আপত্তি জানান। এর ফলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি জানিয়েছিল, তদন্ত প্রতিবেদন না হওয়া পর্যন্ত ফলাফল প্রকাশ করা যাবে না।
২০১৫ সালের ২০ আগস্ট তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম থিসিস পেপার জালিয়াতি এবং হাতে নকল নম্বর আনার অভিযোগে রফিকুলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ৪৬১তম সিন্ডিকেটের ১৩৭ নম্বর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রফিকুলের মাস্টার্স রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে তার ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়।
৫ আগস্টের আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত বছর রফিকুল ইসলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীবের কাছে রেজিস্ট্রেশন পুনর্বহাল এবং ফলাফল প্রকাশের দাবি জানিয়ে লিখিত অভিযোগ দেন। রফিকুলের অভিযোগে উঠে আসে, প্রভাষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে বিভাগের বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আলি আকবর, অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল হক এবং অধ্যাপক ড. মো. আশরাফুজ্জামান খান পূর্বপরিকল্পিতভাবে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন।
কঠিন পরিস্থিতি সত্ত্বেও রফিকুল থেমে থাকেননি। ২০১৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে সিজিপিএ ৪.০০ পেয়ে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন তিনি। এরপর ২০২৪ সালে চীনের ডালিয়ান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক্স বিভাগে আরেকটি মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।
অবশেষে, দীর্ঘ লড়াইয়ের পর রফিকুল ইসলামের ছাত্রত্ব পুনর্বহাল এবং মাস্টার্সের অপ্রকাশিত ফলাফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ছাত্রত্ব ফিরে পাওয়ার আনন্দে রফিকুল ইসলাম বলেন, শহীদ আবু সাঈদ, মুগ্ধ, আলী রায়হান, শাকিল এবং আহনাফ—এই সকল সাহসী তরুণের রক্তের বিনিময়ে দীর্ঘ ১০ বছর ৬ মাস ধরে যে-সব অমানুষিক যন্ত্রণার পাহাড় বয়ে বেড়িয়েছি। আজ তা যেন বুক থেকে নেমে গেল—আলহামদুলিল্লাহ।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, এত দীর্ঘ সময় পর আমার ছাত্রত্ব ফিরে পাওয়ায়, আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের প্রতি চিরকাল কৃতজ্ঞ। যদিও আমার জীবনের সেই হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো কখনোই ফিরে আসবে না, তবুও প্রিয় ক্যাম্পাস থেকে মাস্টার্সের ফলাফল পুনরায় ফিরে পাওয়াটা আমার জন্য এক অপার আনন্দের বিষয়। এই আনন্দের গভীরতা ভাষায় প্রকাশ করা আমার জন্য সত্যিই অসম্ভব।
শিক্ষক-ছাত্রের দ্বন্দ্বের বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষকদের দ্বন্দ্বে আর কোনো ছাত্রের জীবনে যেন এমন অন্ধকার কখনো না নেমে আসে, এটাই আমার প্রার্থনা।
মানবকণ্ঠ/এসআর
Comments