Image description

সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের তৃতীয় স্ত্রী ডা. ফরিদা হক তার খারাপ মেজাজের কারণে কাউকেই ছাড়েন না পিটুনি দিতে। প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, হাসপাতালের আয়া, কাজের বুয়া, ড্রাইভার, বাবুর্চি, নার্স সবাইকেই শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।

ডা. ফরিদার স্বামী কারাগারে থাকায় হাসপাতালের ওপর তার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ায় বিষয়টি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। এরপর থেকে তার আচরণ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এর প্রতিবাদে হাসপাতালের কর্মচারীরা বিক্ষোভ করেছেন, এমনকি তার চেম্বারেও ভাঙচুর চালিয়েছেন। কিন্তু, তাতে তার আচরণে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

তা সত্ত্বেও ক্ষান্ত হননি তিনি। বরং দিন দিন বেড়েছে তার দৌরাত্ম্য। হয়ে উঠেছেন আরো বেপরোয়া। সর্বশেষ পিটিয়েছেন অন্বেষা নামে এনাম নার্সিং কলেজের এক শিক্ষার্থীকেও। এই অন্বেষার বাবা এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মসজিদের খাদেম।

এসব ঘটনায় ক্রমেই ফুঁসে উঠেছেন হাসপাতালটির কর্মচারীরা। ক্ষোভের বিস্ফোরণে যে কোন সময় হাসপাতালটি অচল হয়ে পড়ার শঙ্কায় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কেবল পিটুনিই নয়, দুই মেয়াদে এমপি এবং প্রতিমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে ডা. ফরিদার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে নিয়োগ ও কমিশন বাণিজ্যের।

৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একে একে বেরিয়ে আসছে ডা. ফরিদার নানা অপকর্ম, দুর্নীতি এবং অনিয়মের তথ্য। জানা গেছে, প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী পরিচয়ে ঠিকাদারি, টেন্ডার, চাকরি, বদলি, পদোন্নতি এমনকি ঝুট বাণিজ্যে থেকে নিয়মিত কমিশন নিতেন ডা. ফরিদা।

প্রশ্ন উঠেছে তার চরিত্র নিয়েও। এলাকাবাসী বলছে, তালবাগ নিবাসী ফজলুল হকের মেয়ে ফরিদা। কলেজ পড়ুয়া ফরিদা বিয়ে করেন ফার্মাসিউটিক্যালসের সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ চপলকে। ওই ঘরে তার একটি ছেলে সন্তানও রয়েছে। স্বামী সন্তান থাকা অবস্থাতেই তৎকালীন এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. এনামুর রহমানকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে তাকে বিয়ে করেন এই ফরিদা। লক্ষ্য ছিলো এনামের অঢেল সম্পদ।‌ যে কারণে ছেড়ে দেন ভালোবাসার টানে ভাগিয়ে বিয়ে করা স্বামী ও সন্তানকে।

বয়সে প্রায় ২০ বছর বয়সের ব্যবধান। সম্পর্কে চাচা। ডা. এনামুর রহমানকে বিয়ে করার বিষয়টি প্রথম দিকে কেউ স্বাভাবিকভাবে মেনে না নিলেও কেবলমাত্র অর্থ আর ক্ষমতার প্রতিপত্তির কারণে ধীরে ধীরে এক পর্যায়ে সবাই মেনে নিতে বাধ্য হয়।

রানা প্লাজা ধ্বসের ঘটনার পর আলোচনার পাদ প্রদ্বীপে আসা চিকিৎসক থেকে বিনা ভোটে ২০১৪ সালে রাতারাতি ঢাকা ১৯ আসনের (সাভার- আশুলিয়া) এমপি বনে যান ডা. এনামুর রহমান। তখন প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী ছেড়ে তৃতীয় স্ত্রী ফরিদার সাথে তালবাগের বাসায় একত্রে বসবাসের সূত্রে রাতারাতি সাভারের ফাস্ট লেডি হয়ে ওঠেন ফরিদা। যেকোনো আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে এনামের সাথে তিনিও মর্যাদা পেতে থাকেন বিশেষ অতিথির।

আর এভাবেই সংসদ সদস্য হিসাবে প্রথম মেয়াদে সাভার আশুলিয়ার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, ঠিকাদারি কাজের টেন্ডার, সরকারি চাকরিতে পদোন্নতি, বদলি এমনকি ঝুট ব্যবসার কমিশনের অংশীদার হয়ে ওঠেন ফরিদা। রাতারাতি অঢেল অর্থের মালিক বনে যাওয়ায় ব্যাংকে অস্বাভাবিক লেনদেন খতিয়ে দেখতে তদন্ত শুরু করে সিআইডি। এক পর্যায়ে ব্যাংকে টাকা না রেখে স্বর্ণ এবং জমিতে বিনিয়োগ শুরু করেন ফরিদা। গড়ে তোলেন দেশে-বিদেশে একের পর এক সাম্রাজ্য।

পরের মেয়াদে ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচনে ডা. এনাম প্রতিমন্ত্রী হলে ব্যাপক মাত্রায় আগ্রাসী হয়ে ওঠেন ফরিদা।

অভিযোগ রয়েছে, নানা খাত থেকে কমিশন লাভের পাশাপাশি সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুলেও এনাম মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার্থী ভর্তিতে বাণিজ্য করে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। কমিশন নিয়ে ভাগ বাটোয়ারা ও দ্বন্দ্বের কারণে ২০২১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নিজের বাসায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা (পিও) সাইদুর রহমান সুজনকে বেঁধে পেটান ডা. ফরিদা। পরে ওই ঘটনা ধামাচাপা দিতে ব্যক্তিগত কর্মকর্তার (পিও) পদ থেকে বরখাস্ত করা হয় সাইদুর রহমান সুজনকে।

এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কমপক্ষে এক ডজন শিক্ষার্থী জানান, সরকার ঘোষিত নির্দিষ্ট ফি এর বাইরে ফরিদার হাতে অতিরিক্ত ৫ থেকে ৮ লাখ টাকা দিয়ে তারা এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

সম্প্রতি আশুলিয়ার একটি ডিগ্রী কলেজের একজন জ্যেষ্ঠ নারী শিক্ষক অভিযোগ করে জানান, পদোন্নতির জন্য জনৈক আজাদের মধ্যস্থতায় ফরিদা তার কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে ৩ লাখ টাকা নগদে গ্রহন করেন। দীর্ঘদিন তার পিছে ঘুরে ঘুরেও পদোন্নতি পাননি। পরে ২ লাখ টাকা ফেরত পেলেও এখনো এক লাখ টাকা ফেরত পাননি। টাকা চাইলে উল্টো হুমকি ধমকি দেয়া হচ্ছে তাকে।

ক্রন্দনরত কন্ঠে ওই নারী শিক্ষক বলেন, টাকার পিছনে ঘুরে ঘুরে হয়রান হয়ে গেলাম। তবু টাকা ফেরত পেলাম না। আমাদের মত মানুষদের অভিশাপের কারণে ডা. এনামের আজ এই দশা।

প্রয়োজনীয় ডিগ্রী না থাকা সত্ত্বেও এনাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতিবিদ্যা এবং স্ত্রীরোগবিদ্যা (গাইনী ও অবসর) বিভাগের আবাসিক সার্জনের পদ দখল করে রয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে ফরিদার বিরুদ্ধে। কেবলমাত্র ডিপ্লোমা (ডিজিও) ডিগ্রী দিয়ে তিনি জটিল সব অস্ত্রোপচার করেন। তার হাতে অসংখ্য প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যু হলেও এনামের দাপটে চাপা পড়ে গেছে সবকিছু। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভোক্তভোগীরা তার বিচার দাবি করেছেন।