৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাক-হানাদার বাহিনীকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে চুয়াডাঙ্গাকে শত্রুমুক্ত করেন মুক্তিকামী জনতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও দিনটি স্থানীয়ভাবে গভীর শ্রদ্ধা ও আবেগের সঙ্গে পালিত হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের বহু ন্যায্য দাবি এখনো অপূর্ণ থেকে গেছে। এতে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করছেন তারা।
২৫ মার্চের কালো রাতের গণহত্যার পর চুয়াডাঙ্গায় শুরু হয় তীব্র প্রতিরোধ। যশোর সেনানিবাস পতনের খবর ছড়িয়ে পড়লে শহরের প্রবেশপথে গাছ ফেলে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়। শ্রীমন্ত টাউন হলে আনসার, মুজাহিদ ও স্বেচ্ছাসেবকদের সমবেত করে ট্রেজারি থেকে অস্ত্র-গোলাবারুদ বিতরণ করা হয়।
এই সময় চুয়াডাঙ্গা হয়ে ওঠে এক নিরাপদ মুক্তাঞ্চল। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীকালে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ৩০ মার্চ ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় আসেন এবং স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরিস্থিতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি যুদ্ধকালীন সময়ের জন্য চুয়াডাঙ্গাকে অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করেন।
চুয়াডাঙ্গা থেকে যুদ্ধের বাস্তব চিত্র বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছালে পাকিস্তানি সেনাদের চোখে এটি বড় টার্গেটে পরিণত হয়। ৩ এপ্রিল প্রথম বিমান হামলা হয় চুয়াডাঙ্গার আকাশে। ১০ এপ্রিল আগরতলায় বৈঠকে অস্থায়ী সরকারের শপথ অনুষ্ঠান চুয়াডাঙ্গায় আয়োজনের সিদ্ধান্ত হলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে তা গোপন রাখা হয়। কিন্তু বিদেশি গণমাধ্যমে খবর ফাঁস হয়ে গেলে হামলা আরও নির্মম হয়ে ওঠে।
১৬ এপ্রিল যশোর সেনানিবাস থেকে আগত পাকসেনারা চুয়াডাঙ্গায় ঢুকে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে শহর দখল করে। সদর দপ্তর থাকা অবস্থায় দ্রুত সেটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। তবে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেননি; বরং সংগঠিত হন আরও শক্তিশালীভাবে।
২২ এপ্রিল ভারতের হৃদয়পুরে প্রথম আনুষ্ঠানিক মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প চালু হয় ১২০ জন যুবককে নিয়ে। ১১ জুলাই পুরো দেশ ১১ সেক্টরে বিভক্ত হলে চুয়াডাঙ্গা যুক্ত হয় ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে। সম্মুখ যুদ্ধের পাশাপাশি গেরিলা অভিযানও চলে সমানতালে।
৫ আগস্ট দামুড়হুদার নাটুদহের কাছে বাগোয়ানে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শহীদ হন আট মুক্তিযোদ্ধা—পিন্টু, হাসান, খোকন, কাশেম, রবিউল, রওশন, তারিক ও আফাজউদ্দিন। তাদের দাফন করা হয় জগন্নাথপুর গ্রামের দুটি কবরে, যা আজ ‘আটকবর’ নামে পরিচিত। ৭ আগস্ট ধোপাখালি সীমান্তে আরও পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হামলায় শহীদ হন।
সেপ্টেম্বরে ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবুল মনজুর। তাঁর দক্ষ নেতৃত্বে নতুন কৌশল প্রয়োগের ফলে যুদ্ধ আরও বেগবান হয়। নভেম্বরের শেষ দিকে একে একে নানা এলাকা মুক্ত হতে থাকে—২৬ নভেম্বর জীবননগর, ৪ ডিসেম্বর দর্শনা।
অবশেষে ৭ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা ও আলমডাঙ্গা সম্পূর্ণভাবে হানাদারমুক্ত হয়। সেদিন চুয়াডাঙ্গা মুখরিত হয়ে ওঠে মুক্তিকামী জনতার ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে। আকাশ ভরে ওঠে বিজয়ের পতাকায়।
এতসব ত্যাগ ও বীরত্বের পরও আজও চুয়াডাঙ্গার বহু মুক্তিযোদ্ধা প্রত্যাশিত স্বীকৃতি, সুযোগ-সুবিধা ও উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত। তাদের অভিযোগ—রক্তঝরা সংগ্রামের মূল্যায়ন এখনও যথাযথভাবে হয়নি। তারা মনে করেন, স্বাধীন জেলার উন্নয়ন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি।
চুয়াডাঙ্গা মুক্ত দিবস তাই শুধু ঐতিহাসিক গৌরবের স্মারক নয়; বরং অপূর্ণ দায়বদ্ধতারও স্মরণিকা।




Comments