মেট্রোরেল দুর্ঘটনার দায় বিয়ারিং প্যাডের নয়, ত্রুটিপূর্ণ স্থাপন ও পরিদর্শনে: ডিএমটিসিএল এমডি
ঢাকার মেট্রোরেল চালুর আগে পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা নিরীক্ষা (সেফটি অডিট) না হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। সম্প্রতি বিয়ারিং প্যাড পড়ে এক পথচারীর মৃত্যুর পর নতুন করে নিরাপত্তা নিরীক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সোমবার সকালে উত্তরার দিয়াবাড়িতে মেট্রোরেলের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফারুক আহমেদ এই তথ্য জানান।
তিনি বলেন, "মেট্রোরেলের আগে সেফটি অডিট হয়নি। তাই সেফটি অডিট করতে চাইছি। যত দ্রুত করা যায়, সেটা আমরা করব।" তিনি আরও জানান, তৃতীয় পক্ষ হিসেবে ইউরোপীয় কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়ে এই অডিট করানো হবে এবং ফ্রান্সের দুটি প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে আবেদন করেছে। খুব শিগগির টেন্ডার প্রক্রিয়ায় যাওয়া হবে।
এক বছর আগে ঢাকার মেট্রোরেলের স্তম্ভের একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়েছিল। সর্বশেষ গত ২৬ অক্টোবর ফার্মগেটে আরেকটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়লে এক পথচারীর মৃত্যু হয়। এই দুর্ঘটনার পর শাহবাগ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল চলাচল ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় বন্ধ ছিল।
বিয়ারিং প্যাড পড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের এমডি বলেন, "বিয়ারিং প্যাড হঠাৎ করে পড়ে যায়নি। এটা হঠাৎ করে পড়ে যাওয়ার জিনিস নয়।" তিনি তদন্তাধীন বিষয়ে সরাসরি মন্তব্য না করলেও সম্ভাব্য কারণ হিসেবে ডিজাইন ফল্ট, ঠিকাদারের ত্রুটিপূর্ণ স্থাপন, অথবা পরামর্শকদের ঠিকভাবে বুঝে না নেওয়ার বিষয়গুলো উল্লেখ করেন।
ফারুক আহমেদ জোর দিয়ে বলেন, "দোষ কিন্তু বিয়ারিংয়ের নয়। বিয়ারিং যে লাগিয়েছে, সেটি বাজেভাবে লাগানো হয়েছে কি না? যার আসলে বুঝে নেওয়ার দায়িত্ব ছিল, সে বুঝে নিয়েছে কি না, সেগুলো এখন দেখতে হবে।"
তিনি আরও জানান, এই কাজগুলো বুঝে নেওয়ার জন্য হাজার কোটি টাকায় বিদেশি পরামর্শক নিয়োগ করা আছে। "প্রথম ঠিকাদারের কাছ থেকে বুঝে নেবেন পরামর্শক। আমাদের বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পরামর্শকদের," উল্লেখ করে তিনি বলেন, "তখন এই কাজগুলো কিছুটা তাড়াহুড়া হয়েছে। কেন হয়েছে, সেটার উত্তর তো আমি দিতে পারব না। যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সেই অংশে অনেক ডিফেক্ট আছে। ফলে সেটা এখনো আমরা বুঝে নিইনি।"
ডিএমটিসিএল এমডি জানান, যে অংশে বিয়ারিং প্যাড পড়ে গিয়েছিল, সেই অংশের ত্রুটি সারিয়ে দেওয়ার সময়সীমা (ডিফেক্ট লায়াবেলিটি) গত জুন পর্যন্ত ছিল। কিন্তু ডিএমটিসিএল এই সময়সীমা গ্রহণ করেনি, কারণ এখনো অনেক বড় ত্রুটি রয়ে গেছে। ঠিকাদারকে এসব সমস্যা মেরামত করতে হবে এবং এজন্য ‘ডিফেক্ট লায়াবেলিটি’ দুই বছর বাড়ানোর জন্য ঠিকাদারকে বলা হয়েছে।
দুর্ঘটনার পর মেট্রোরেলের সব কটি পিলার পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে পুরো পথের বিয়ারিং প্যাডের ছবি তোলা হয়েছে এবং কর্মকর্তারা সরেজমিনে নিরীক্ষা করেছেন। ত্রুটি শনাক্ত হওয়া স্থানগুলোতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে জানানো হয়েছে এবং ডিএমটিসিএলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো, যেখানে ত্রুটি বা সমস্যা পাওয়া যাবে, সেখানে বিয়ারিং প্যাড অবশ্যই পরিবর্তন করা হবে।
ফারুক আহমেদ বলেন, চার বছর আগে তাড়াহুড়া করে ঢাকার মেট্রোরেল চালু করা হয়েছিল। প্রকল্প চালুর আগে ন্যূনতম ছয় থেকে নয় মাসের পরীক্ষামূলক চলাচল নিশ্চিত করার প্রয়োজন ছিল। তিনি বলেন, তিন বছরে মেট্রোরেল চালু হবে বা পাঁচ বছরে মেট্রোরেল সম্পূর্ণ হবে—এ ধরনের ধারণা আসলে ভুল। যেকোনো মেট্রোরেল নির্মাণের জন্য সব ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার পর ছয় থেকে সাত বছর লাগে। এর আগে প্রকল্প প্রণয়ন, সম্ভাব্যতা যাচাই ও অন্যান্য প্রস্তুতিতে চলে যায় তিন বছর।
২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের যে লক্ষ্যমাত্রা আগে নেওয়া হয়েছিল, তা কিসের ভিত্তিতে হয়েছে, তা তার বোধগম্য নয় বলেও মন্তব্য করেন ডিএমটিসিএলের এমডি।
নতুন মেট্রোরেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ফারুক আহমেদ বলেন, "মেট্রোরেল প্রকল্প মুখ থুবড়ে পড়েনি। মেট্রোরেল আমাদের লাগবে। আমাদের লক্ষ্য হলো, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এই প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ করতে সক্ষম হয়। সরকারের উদ্দেশ্য হলো একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করা, যাতে একাধিক প্রতিষ্ঠান অংশ নিতে পারে এবং কম খরচে উন্নত মানের মেট্রোরেল নির্মাণ সম্ভব হয়। মেট্রোরেল আমাদের করতেই হবে; তবে তা হবে স্মার্ট ফাইন্যান্সিংয়ের মাধ্যমে।"




Comments