
পশ্চিম মহিষাবানের ত্রিমোহিনীতে ইছামতী নদীর তীরে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নারীদের একটি বিশেষ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, যা 'বউ মেলা' নামে পরিচিত। এই মেলাটি কেবল নারীদের জন্য, যেখানে চুড়ি, আলতা, চিরুনি থেকে শুরু করে হাঁড়ি-পাতিল, খেলনা, মিষ্টান্ন সবকিছুই পাওয়া যায়। এমনকি এই মেলার বিক্রেতারাও সাধারণত নারী হয়ে থাকেন। নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণেই এই মেলার নামকরণ করা হয়েছে ‘বউ মেলা’।
দিনব্যাপী এই মেলায় নারীরা ঘুরে ফিরে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনেন। প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষ বৃহস্পতিবার এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আগের দিন একই জায়গায় পোড়াদহ মেলা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর আজ সকাল থেকেই ‘বউ মেলা’য় নারীদের ঢল নামে।
মেলার আয়োজকদের মতে, বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার ইছামতী নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী ‘পোড়াদহ মেলা’। এর পরদিন, বৃহস্পতিবার, বসে ‘বউ মেলা’। পোড়াদহ মেলা নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানান জনশ্রুতি। প্রায় ৪০০ বছর আগে, মাঘ মাসের শেষ বুধবার, ইছামতী নদীতে একটি বড় কাতলা মাছ সোনার চালুনি পিঠে নিয়ে অলৌকিকভাবে ভেসে উঠেছিল। ওই ঘটনা থেকেই মেলা বসার প্রথা শুরু হয় এবং সময়ের সঙ্গে এটি পোড়াদহ মেলা নামে পরিচিতি পায়। মেলায় স্থানীয় জেলেরা ইছামতী, করতোয়া, যমুনা ও বাঙ্গালী নদীর নানা প্রজাতির মাছ বিক্রি করতে নিয়ে আসেন। এসব মাছ কিনতে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতা ও দর্শনার্থীরা ভিড় করেন। যদিও মেলা এক দিনের, তবে এর উৎসবের পরিবেশ কয়েকদিন ধরে অনুভূত হয়।
স্থানীয় লোকজন জানান, ঐতিহ্যবাহী মেলা ঘিরে গাবতলীর মহিষাবান ইউনিয়ন ছাড়াও আশপাশের গাবতলী সদর, দুর্গাহাটা, বালিয়াদীঘি ও নশিপুর ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের ঘরে ঘরে চলছে উৎসব। মেলা উপলক্ষ্যে শ্বশুরবাড়িতে নিমন্ত্রণ পেয়েছেন অনেক পুরুষ সদস্য। আর মেয়েরা এসেছেন বাবার বাড়িতে। পোড়াদহ মেলায় লাখো মানুষের ভিড়ের কারণে মেয়েরা মেলায় আসতে পারেন না। এ জন্য প্রায় তিন দশক ধরে জামাই মেলার এক দিন পর ত্রিমোহিনী গ্রামে নারীদের জন্য বউ মেলার আয়োজন করা হয়।
মেলায় ক্রেতা-বিক্রেতা সবাই নারী হলেও, কিছু কিশোর ও পুরুষ বিক্রেতাও ছিলেন। তবে, সন্ধ্যার আগে কোনো পুরুষ মেলায় প্রবেশ না করেন, তা আগে থেকেই বলা ছিল। আজকের মেলায় নারীদের প্রসাধনী ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পণ্যের পসরা বসেছিল। মিষ্টির দোকানে সাজানো ছিল হরেক রকমের মিষ্টান্ন, যেমন - সন্দেশ, জিলাপি, নিমকি, বাতাসা, তিলের নাড়ু, খই, শুকনা মিষ্টি, কদমা, চিনি ও গুড়ের জিলাপি। এছাড়াও, ছিল মাটি ও কাঠের খেলনা, বাঁশি, টমটম, রঙিন বেলুন, চটপটি, ফুচকা, মৌসুমি ফল, চাটনি, আচার, কাঁচের চুড়ি, আলতা-ফিতা, লিপস্টিক, নেইল পলিশ, প্রসাধনীসহ আরও অনেক পণ্যের দোকান। নারী ও শিশুদের বিনোদনের জন্য ছিল চরকি, নাগরদোলা, ট্রেন রাইডসহ নানা আনন্দ আয়োজন।
মহিষাবান গ্রামের এক গৃহবধূ বলেন, ‘পুরুষের ভিড়ে পোড়াদহ মেলায় যাওয়া যায় না। তাই এটা এই এলাকার বউ-মেয়ে-ঝিদের প্রাণের মেলা। ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় এসে পুরোনো বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ মেলে। আনন্দে প্রাণ ভরে যায়।’
রানীরপাড়া গ্রামের আরেক গৃহবধূ জানান, ‘মেলায় এসে আলতা, চুড়ি ও ফিতা কিনেছি। নাগরদোলায় উঠেছি, গরম জিলাপি, চটপটি-ফুচকা খেয়েছি। খুব মজা করেছি।’
মেলা আয়োজক কমিটির সভাপতি ও গাবতলী উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মশিউর রহমান সুমন বলেন, অন্যবারের তুলনায় এবারের মেলায় উৎসবমুখর পরিবেশে নারীরা উচ্ছ্বসিত। এ মেলায় পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও পুরুষের প্রবেশ ঠেকাতে শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক কাজ করছেন।
স্বেচ্ছাসেবকেরাও কেউ মেলায় প্রবেশ করতে পারবেন না। পোড়াদহ মেলার মতোই বউ মেলাকে সর্বজনীন মেলায় রূপ দিতে আয়োজকেরা নিরলসভাবে কাজ করছেন।
মানবকণ্ঠ/এসআর
Comments