Image description

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষিতে সমৃদ্ধ জেলা বগুড়া। উর্বর মাটি, অনুকূল আবহাওয়া এবং কৃষিবান্ধব পরিবেশ এই জেলার কৃষিকে দিয়েছে এক অনন্য পরিচিতি। কৃষির এই সমৃদ্ধ ধারায় বিশেষভাবে আলোচিত শাজাহানপুর উপজেলার ছোট্ট গ্রাম শাহনগর—যা এখন সারা দেশে ‘চারা গ্রাম’ নামে পরিচিত। এই গ্রামের প্রতিটি জমিতে ছড়িয়ে আছে সবুজের সমারোহ। এখানকার মানুষ শুধু কৃষক নন, তারা যেন সবুজ স্বপ্নের কারিগর।

সকালের ঝলমলে রোদে চোখে পড়ে পলিথিনে মোড়ানো রঙিন টানেল, যার নিচে সযত্নে লালিত হচ্ছে সারি সারি সবুজ চারা। পুরুষরা জমি প্রস্তুতের কাজে ব্যস্ত, নারীরা যত্নে আগাছা পরিষ্কার করছেন। কেউ চারা তোলার কাজে নিয়োজিত, কেউবা প্যাকেজিংয়ের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। দূর থেকে মনে হয়—পুরো গ্রামটিই যেন এক বিশাল কৃষি গবেষণাগার, যেখানে প্রতিটি মানুষ মাটির সঙ্গে মিশে গড়ে তুলছেন সবুজের এক জীবন্ত স্বপ্ন।

একসময় যে গ্রামের মানুষ শুধুই মৌসুমি কৃষিকাজের ওপর নির্ভর করতেন, আজ সেই গ্রামই দেশের অন্যতম চারা উৎপাদনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। এখানকার উৎপাদিত মরিচ, বেগুন, টমেটো, লাউ, করলা, ও অন্যান্য সবজির চারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা হয়। 

শুধু শাহানগরই নয়, কামারপাড়া, খোট্টাপাড়া, দুরুলিয়া, বড়পাথার ও দরিকুল্যা গ্রামজুড়ে রয়েছে প্রাই আড়াই শতাধিক নার্সারি।  শাজাহানপুরে উৎপাদিত এসব চারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ টি জেলায়।

এখানে বিভিন্ন জাতের সবজির চারা উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে মরিচের জনপ্রিয় হাইব্রিড জাতগুলো হলো; কারিশমা, টাইগার, কিসমত, সুলতান, লাইট মাস্টার, ময়নামতি এবং গ্রীন সুপার। এসব জাতের চারা রোগবালাই কম হয় এবং ফলন বেশি হওয়ায় কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ফুলকপি ও বাঁধাকপির জাতগুলোর মধ্যে রয়েছে শিলা, কুসুম ও নারিশ জাত। বেগুনের মধ্যে রয়েছে আলতামাস, মেন্টাল বোম্বাই ও কালিয়া জাতের। এছাড়া টমেটোরও বিভিন্ন উন্নত জাতের চারা এখানে পাওয়া যায়।

জাতভেদে প্রতি হাজার চারা ৯০০ থেকে ১,৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

নার্সারি মালিক সমিতির সভাপতি আমজাদ হোসেন বলেন, ১৯৮৫ সাল থেকে শাহনগরে চারা উৎপাদন শুরু হয়েছে। প্রায় চার দশক আগে আমি বাণিজ্যিকভাবে চারা উৎপাদন শুরু করি। ধীরে ধীরে এ কার্যক্রম বিস্তৃত হতে থাকে, এবং আমার হাত ধরেই শাহনগর আজ ‘চারার নগর’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

তিনি আরও বলেন, চলতি মৌসুমে ২০ থেকে ২৫ কোটি চারা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। আমাদের এখানে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে সুস্থ, সবল ও মানসম্মত চারা উৎপাদিত হচ্ছে। যা দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আমিনা খাতুন জানান, কৃষকদের দক্ষতা ও উৎপাদন বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কৃষকদের যেকোনো সমস্যায় কৃষি বিভাগ সবসময় তাদের পাশে রয়েছে। মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা নিয়মিত পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করছেন, যাতে চারা উৎপাদনসহ সামগ্রিক কৃষি কার্যক্রম আরও উন্নত ও লাভজনক হয়।

বর্তমানে শাহনগরের শত শত পরিবার এই চারা ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। এতে শুধু গ্রামীণ অর্থনীতি নয়, বদলে গেছে মানুষের জীবনযাত্রার মানও। যুবকেরা আর কর্মসংস্থানের জন্য শহরমুখী নয়—বরং নিজ গ্রামেই গড়ে তুলছে ছোট ছোট নার্সারি, ছড়িয়ে দিচ্ছে সবুজের স্বপ্ন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।