
এবারের মেলার প্রথম শুক্রবার ছিল গতকাল। মেট্টোরেল থেকে নেমে বইমেলায় প্রবেশের প্রস্তুতি নিতেই চোখে পড়ে লম্বা লাইন। মনে আনন্দ নিয়ে লাইনে দাঁড়াই। প্রায় ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করে কাঙ্খিত প্রাণের বইমেলায় প্রবেশ করি। সংবাদ সংগ্রহের জন্য পুরো মেলায় চক্কর দিয়ে পরিবেশ রপ্ত করি। গতকাল দর্শনার্থীর বেশ ভিড় ছিল। ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশের সামনে দেখা হয় রুদ্রের সঙ্গে। রুদ্র কলেজে পড়েন। হাতে বইয়ের ব্যাগ। কী ধরনের বই পড়েন, এমন প্রশ্নে রুদ্র বলেন, ‘উপন্যাস-গল্প বেশি ভালো লাগে। বেশি পড়ি।’ গত কয়েক দিনের হতাশা কাটিয়ে গতকাল ছিল প্রকাশকদের স্বপ্ন দেখার দিন। সবার মুখে ছিল হাসি।
মেলা শুরুর পর থেকে শুক্রবারের অপেক্ষায় ছিলেন প্রকাশকরা। কারণ কর্মব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে সপরিবারেই বইপ্রেমীরা এমন দিনে মেলায় ছুটে আসে। ছুটির দিনে মেলা লোকে লোকারণ্য হবে, স্টল ও প্যাভিলিয়নের সামনে পাঠকদের জটলা থাকবে এমন আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় থাকা দিনটি এলো আর প্রকাশকদের প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তিও ঘটালো। পাঠকরা এলেন, মেলাকে উৎসবমুখর করে তুললেন এবং প্রিয় লেখকের পছন্দের বই কিনেই বাড়ি ফিরলেন এমন দৃশ্যই লক্ষণীয় ছিল অমর একুশে বইমেলার সপ্তম দিন গতকাল শুক্রবার। এদিন ছিল এবারের মেলার প্রথম শুক্রবার ও মেলার প্রথম শিশুপ্রহর। বেলা ১১টায় মেলার প্রবেশদ্বার উšে§াচনের পরই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দৃশ্যপট পালটে যায়। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত শিশুপ্রহরের শিশু চত্বরে ক্ষুদে পাঠকদের কোলাহল, দুষ্টুমি ও বাবা-মায়ের হাত ধরে বই কেনার দৃশ্য অন্যরকম ভালো লাগার পরিবেশ সৃষ্টি করে। দুই ঘণ্টার শিশুপ্রহরে বাবা-মায়ের কাছে বায়না ধরে প্রিয় লেখকের বইটি আদায় করে নেয় সোনামণিরা। ক্ষুদে পাঠকদের পছন্দের তালিকায় ছিল কার্টুন, কমিকস, ছবি আঁকার বই, রূপকথার গল্পের বইসহ শিশুদের আনন্দ দানের বিভিন্ন বই। সকালে শিশু চত্বরে কথা হয় রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলার নয়ানগর থেকে আগত আব্দুল হাই-জান্নাত দম্পতির সাথে। নিজেদের দুই কন্যা সুমাইয়া ও মারিয়াকে নিয়ে মেলায় আগত এই দম্পতি বলেন, ‘ডিজিটাল যুগে বাচ্চারা যখন মোবাইলে আসক্ত তখন আমরা আমাদের বাচ্চাদের হাতে বই তুলে দিয়েছি। সবারই উচিত বাচ্চাদেরকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলা।’ কি বই ভালো লাগে জানতে চাইলে ক্ষুদে পাঠক সুমাইয়া ও মারিয়া সমস্বরে বলেন, ‘কার্টুনের বই ঠাকুরমার ঝুলি পড়তে ভালো লাগে।’ শিশু চত্বরে এ সময় প্রায় সব শিশুর হাতেই বই শোভা পাচ্ছিল। সকালে শিশুদের কোলাহল শেষে বিকালে বড়দের আগমণে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে অগ্রিম সফলতার ঘ্রাণ পায় প্রকাশকরা। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে পাঠকদের ভিড়ে মেলাজুড়ে চিত্রিত হয় ভালো লাগার পরিবেশ। মেলাবিকাল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে মেলার প্রবেশদ্বার বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত স্টল ও প্যাভিলিয়নে বিকিকিনিতে ব্যস্ত ছিলেন প্রকাশনা সংস্থায় কর্মরতরা। পাঠকদের বইকেনার দৃশ্যে রাজ্যের ভালোলাগা ফুটে উঠে প্রকাশকদের চোখেমুখে। এদিনের মেলা নিয়ে সৃজনী প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী মশিউর রহমান বলেন, ‘শুক্রবারের অপেক্ষায় আমরা যেই আশায় ছিলাম সেই আশার পরিস্ফুরণ ঘটেছে।’ বিক্রি ভালো হচ্ছে জানিয়ে মুক্তদেশ প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী জাভেদ ইমন বলেন, ‘শুক্রবারের বিক্রির ধারাবাহিকতা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে এবার ভালো কিছু হবে বলে আশা করছি।’
ছুটির দিনের মেলা নিয়ে অনন্যা প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী মনিরুল হক বলেন, ‘যেমনটি আশা করছিলাম তার চেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে। অন্যান্যবারের প্রথম শুক্রবারের তুলনায় এবারের প্রথম শুক্রবারে ভিড় বেশি হয়েছে এবং বিক্রি বেশি হয়েছে। বলতে পারি প্রত্যাশার চেয়ে আমাদের প্রাপ্তিটা বেশি ঘটেছে। পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক থাকে তাহলে অন্যান্যবারের চেয়ে এবার আমরা একটি বেশি সফল মেলা পাবো বলে আশা করছি।’
বিকাল গড়িয়ে গোধুলীলগ্নে পুথি প্রকাশের স্টলে দেখা হয় লেখক জমির উদ্দিন মিলনের সাথে। নিজের মোটিভেশনাল বই ‘চিন্তা থেকে জয়’ বইয়ের ওপর পাঠকদের অটোগ্রাফ সময় এবারের মেলা নিয়ে এই লেখক বলেন, ফ্যাসিবাদের পতনের পর কর্তৃত্ববাদী মেলা থেকে এবারের মেলা অংশগ্রহণমূলক মেলায় পরিণত হয়েছে। খুবই ভালো লাগছে। ‘চিন্তা থেকে জয়’ বইটি পাঠকদের ভালো লাগার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে জমির উদ্দিন মিলন বলেন, মানুষ এখন নতুন কিছু চায়। মোটিভেশনাল বই তরুণ প্রজš§কে যেভাবে আকৃষ্ট করতে পারে অন্য কোনো বই সেভাবে আকৃষ্ট করতে পারেনা। বইটিতে মানুষের মনোজাগতিক বিভিন্ন সমস্যার কারণ ও এর সমাধানও দেয়া হয়েছে। যার কারণে বইটি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। অমর একুশে বইমেলার সপ্তম দিনে গতকাল নতুন বই এসেছে ১৮৪টি। গত সাত দিনে মোট নতুন বই প্রকাশ পেয়েছে ৪৫৪টি।
সরকার ‘মব জাস্টিস’কে কোনোভাবেই সমর্থন করে না: সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বলেছেন, বর্তমান সরকার ‘মব জাস্টিস’কে কোনোভাবেই সমর্থন করে না। যেখানেই এ ধরনের মব জাস্টিস হচ্ছে, তা ঠেকানোর জন্য সরকার চেষ্টা করছে বলেও জানান তিনি। গতকাল বিকালে অমর একুশে বইমেলার বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে চায়না বুক স্টল পরিদর্শনে এসে তিনি এসব বলেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। সংস্কৃতি উপদেষ্টা বলেন, ‘চীন আমাদের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী। আগামী বছর আমরা দশটা বই যৌথভাবে প্রকাশ করার ব্যাপারে কাজ করছি। এই সংখ্যা পরে আরও বাড়বে।’ চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, চীন এরই মধ্যে বাংলাদেশের মানুষদের জন্য চিকিৎসা সেবা বাড়াতে হাসপাতাল তৈরি করছে।
শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা: অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে সকাল সাড়ে ৮ টায় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তার। এতে ক-শাখায় ৩০৩, খ-শাখায় ৩২৫ এবং গ-শাখায় ১২২ জন সর্বমোট ৭৫০জন প্রতিযোগী অংশ নেয়।
শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতা: সকাল ১০টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার প্রাথমিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ক-শাখায় ১৪১ জন, খ-শাখায় ২০৭ জন এবং গ-শাখায় ৮৫ জন সর্বমোট ৪৩৩ জন প্রতিযোগী অংশ নেয়। বিচারক ছিলেন ড. তারিক মনজুর, অধ্যাপক শায়লা আহমেদ এবং বাচিকশিল্পী শফিকুর রহমান বাহার।
মূল মঞ্চ: বিকাল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দর্পণে গোলাম মুরশিদ পাঠ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সামজীর আহমেদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন স্বরোচিষ সরকার এবং গাজী মো. মাহবুব মুর্শিদ। সভাপতিত্ব করেন মোরশেদ শফিউল হাসান। প্রাবন্ধিক বলেন, গোলাম মুরশিদের ইতিহাসভিত্তিক আলোচনা বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস-চর্চায় পথিকৃৎ সমতুল্য। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ইতিহাস প্রাতিষ্ঠানিকতা পেলে গোলাম মুরশিদ হবেন তার পুরোধা ব্যক্তি। তার ইতিহাস চর্চার প্রধানতম বৈশিষ্ট্যগুলো হলো উপেক্ষিতের প্রতি নজর, আন্তঃশৃঙ্খলাধর্মীতা এবং ব্যক্তিকে ইতিহাসের কর্তাসত্তায় অধিষ্ঠিত করা। বাংলাদেশে প্রথাগত ইতিহাস-চর্চায় তার নাম যতটা উজ্জ্বল, এর চেয়ে সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তিনি দারুণ শক্তিমান। বাংলা সাহিত্যের প্রত্যক্ষ ইতিহাস না লিখলেও তার ইতিহাস-চর্চা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।
আলোচকদ্বয় বলেন, গোলাম মুরশিদের গবেষণা ও লেখালেখির জগৎ ছিল বিস্তৃত এবং বৈচিত্র্যময়। তিনি ছিলেন গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এবং প্রজ্ঞাময় একজন গবেষক। অত্যন্ত নির্মোহভাবে তিনি ইতিহাসকে দেখার চেষ্টা করেছেন। সাহিত্য বিশ্লেষণ করে ইতিহাস ও জীবনী অনুসন্ধানে আত্মনিয়োগ করেছিলেন গোলাম মুরশিদ। সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানের ইতিহাস ও রাজনৈতিক ইতিহাস চর্চা ছাড়াও অভিধান চর্চার দিক থেকেও গোলাম মুরশিদ উজ্জ্বলতম নাম হয়ে থাকবেন। সভাপতির বক্তব্যে মোরশেদ শফিউল হাসান বলেন, বৈচিত্র্যসন্ধানী, গভীরস্পর্শী ও পরিশ্রমী গবেষক গোলাম মুরশিদ বাংলাদেশের গবেষণা জগতে শ্রেষ্ঠ গবেষকদের একজন। বিদ্যাচর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি আমাদের ও ভবিষ্যৎ গবেষকদের জন্য বাতিঘর হয়ে থাকবেন।
জুলাই’র গল্প মঞ্চ: জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪-এর শহীদ স্মরণে আজকের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে কথা বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। সঞ্চালানায় ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক জুবায়ের ইবনে কামাল। লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন- কবি ও কথাসাহিত্যিক ইকতিজা আহসান ও কবি মৃদুল মাহবুব। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন- ইসমত আরা এবং মুহাম্মদ ইসমাইল। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী আরিফুল হাসান এবং আফরোজা পারভীন। ছিল ফরিদুল হকের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘মাটির সুর সংগীত পরিষদ’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী জি এম জাকির হোসেন, তানজিনা করিম স্বরলিপি, মাকসুদুর রহমান মোহিত খান, চম্পা বণিক, মুর্শিদা নাহিদ এবং শাহনাজ রহমান স্বীকৃতি।
মানবকণ্ঠ/এসআরএস
Comments