Image description

বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হলো তৈরি পোশাক শিল্প। বর্তমানে, বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু দেশীয় পোশাক শিল্পের সুরক্ষা এবং উন্নয়নের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, তার বিপরীতে এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে বিদেশি পোশাক আমদানিতে শুল্কছাড় দেয়ার সিদ্ধান্তটি মোটেও যুগোপযোগী হয়নি। 

প্রস্তাবিত বাজেটে ১৭২ ধরনের বিদেশি পোশাক আমদানিতে শুল্ক ছাড়ে ১২২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যেটা দেশীয় পোশাক শিল্পের জন্য বড় ধরনের একটা চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। 

প্রথমত, বিদেশি পোশাক আমদানিতে শুল্কছাড়ের ফলে দেশীয় পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তাদের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এ ধরনের শুল্কছাড়ের কারণে দেশীয় উদ্যোক্তাদের কাঁচামালের খরচ বৃদ্ধি পাবে, যা তাদের উৎপাদন খরচও বাড়িয়ে দেবে। দেশীয় উদ্যোক্তারা তাদের তৈরি পোশাকের দাম বাড়াতে বাধ্য হবে, যা তাদের পণ্যকে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেবে। বিদেশি পোশাক শুল্কছাড়ের কারণে বিদেশি পোশাকগুলো বাজারে আরও সাশ্রয়ী মূল্যে সহজলভ্য হবে। এতে করে ভোক্তারা সস্তায় বিদেশি পোশাক কিনতে উৎসাহী হবে, যা দেশীয় পোশাকের বিক্রয়কে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের ছোট উদ্যোক্তারা, যাদের সম্পদ ও পুঁজি সীমিত, তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। 

দেশীয় ব্লক-বুটিক এবং ছোট পোশাক প্রস্তুতকারীরা সাধারণত সীমিত পুঁজিতে কাজ করেন এবং তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহার করে থাকেন। বিদেশি পোশাকের সহজলভ্যতা তাদের পণ্যের বাজার প্রতিযোগিতাকে আরও কঠিন করে তুলবে। তারা বাজারে টিকে থাকার জন্য চাইলেও প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য বিক্রি করতে পারবে না, যার ফলে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং অনেকেই হয়তো ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হবে। 

দ্বিতীয়ত, বিদেশি পোশাক আমদানির ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশি টাকা দিয়ে বিদেশি পোশাক কিনতে গেলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাবে। এর ফলে দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাওয়ার ফলে দেশের ডলার সংকট বেড়ে যাবে। 

দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বৈদেশিক মুদ্রার একটি সুষম সরবরাহ প্রয়োজন। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার এই সঞ্চালন দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা হ্রাস করবে এবং ডলার সংকট আরও ঘনীভ‚ত করবে। ডলার সংকটের ফলে দেশের মুদ্রার মান পতিত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। মুদ্রার মান পতিত হলে আমদানি খরচ বেড়ে যাবে, যা দেশের অর্থনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ডলার সংকট এবং মুদ্রার মান হ্রাস অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে দুর্বল করবে এবং আর্থিক বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে। 

তৃতীয়ত, দেশের বাজারে বিদেশি পোশাকের সহজলভ্যতা এবং সাশ্রয়ী মূল্য দেশীয় পোশাকের চাহিদাকে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেবে। ক্রেতারা সহজে বিদেশি পোশাকের দিকে ঝুঁকবে, যার ফলে স্থানীয় পোশাক শিল্প সংকটে পড়বে। দেশীয় উদ্যোক্তারা বাজারে টিকে থাকতে পারবে না এবং তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানও হুমকির মুখে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশীয় পোশাক শিল্পের সুরক্ষায় সরকারকে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। 

বিদেশি পোশাক আমদানিতে শুল্ক কমানোর প্রস্তাব বাতিল করে দেশীয় পোশাক শিল্পকে রক্ষা করতে একটি কার্যকর শুল্ক কাঠামো পুনর্গঠন করা অত্যন্ত জরুরি। দেশীয় পোশাকের ওপর ভ্যাট কমিয়ে দিলে স্থানীয় ক্রেতাদের মধ্যে দেশীয় পণ্য কেনার প্রবণতা বাড়বে এবং স্থানীয় বাজারে চাহিদা বৃদ্ধি পাবে, যা আমাদের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য উৎসে কর হ্রাস করে এবং তাদের উপর থেকে করের বোঝা কমিয়ে তাদের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে, যা তাদেরকে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার সহায়তা করবে। এভাবে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা আরও সহজে ব্যবসায়িক পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে এবং নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে পারবে। 

স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে সহজ ঋণ সুবিধা, কর রেয়াত এবং বিভিন্ন প্রণোদনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। এতে তাদের উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পাবে এবং তারা আরও বেশি উৎপাদনশীল হতে পারবে, যা দেশের অর্থনীতিকে উন্নয়নের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেবে। স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যক্রমে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পেলে দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাবে। 

এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণের মাধ্যমে আমরা দেশীয় পোশাক শিল্পের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারব, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং কর্মসংস্থানের উন্নয়নে বিশেষভাবে সহায়ক হবে। দেশীয় পোশাক শিল্পকে সমর্থন করার মাধ্যমে আমরা কেবল নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করব না, বরং স্থানীয় শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনযাত্রার মানও উন্নত করতে সক্ষম হব। 

সরকারের এ ধরনের উদ্যোগ কেবলমাত্র বর্তমান সমস্যার সমাধান নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভিত্তি সুদৃঢ় করবে। একটি সমন্বিত ও সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের মাধ্যমে আমরা দেশীয় পোশাক শিল্পকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব এবং দেশীয় উৎপাদনের চাকা আরও দ্রুত গতিতে ঘুরাতে পারব। 

দেশের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থান রক্ষার জন্য দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা অত্যন্ত জরুরি। বর্তমান বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে এবং স্থানীয় শিল্পের উন্নতি নিশ্চিত করতে হলে, আমাদের দেশীয় শিল্পগুলোকে সমর্থন এবং সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। 

বৈদেশিক পোশাক আমদানির ওপর শুল্ক কমানোর মাধ্যমে আমরা দেশীয় শিল্পকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিচ্ছি, যা একটি দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে। দেশীয় শিল্পকে সহায়তা করার জন্য সরকারের উচিত একটি সুদৃঢ় এবং কার্যকর নীতি গ্রহণ করা। বৈদেশিক পোশাক আমদানির পরিবর্তে, আমাদের দেশীয় শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এবং আধুনিক প্রযুক্তির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণপ্রাপ্তি, গবেষণা এবং উন্নয়নের জন্য প্রণোদনা দেয়া উচিত, যাতে তারা উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে এবং আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি, বিভিন্ন উদ্ভাবনী উদ্যোগের মাধ্যমে দেশীয় শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। 

দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষার মাধ্যমে আমাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব। এটি দেশের মুদ্রার মান বজায় রাখতে সহায়ক হবে, কারণ বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চালন দেশেই থাকবে এবং বিদেশে মুদ্রার প্রবাহ কমবে। এছাড়া, দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা স্থানীয় কর্মসংস্থানের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশীয় শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং বর্তমান কর্মসংস্থানের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে। এতে কর্মসংস্থানের অভাবজনিত দারিদ্র্য কমবে এবং স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। 

দেশীয় উদ্যোক্তাদের সুরক্ষার জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সরকারকে এই বিষয়ে একটি সুসংহত নীতি গ্রহণ করতে হবে, যেখানে দেশীয় শিল্পকে সহযোগিতা এবং সুরক্ষা প্রদানের জন্য একটি নির্দিষ্ট কাঠামো থাকবে। ব্যবসায়িক পরিবেশকে ব্যবসাবান্ধব করে তোলা, আইনগত সহায়তা প্রদান, এবং ব্যবসায়িক ঝুঁকি কমানোর জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া, আমাদের দেশের ভোক্তাদেরও দেশীয় পণ্যের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। 

দেশীয় পণ্য কেনার মাধ্যমে আমরা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতে পারি এবং স্থানীয় শিল্পকে সমর্থন দিতে পারি। দেশের শিল্পকে সুরক্ষার জন্য আমাদের নিজেদেরকেও উদ্যোগী হতে হবে এবং স্থানীয় পণ্যকে সমর্থন দিয়ে দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে। 

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং কর্মসংস্থানের জন্য দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা এবং উন্নয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। বৈদেশিক পোশাক আমদানির শুল্ক কমানোর পরিবর্তে দেশীয় শিল্পকে সহায়তা করার নীতি গ্রহণ করা উচিত। এর মাধ্যমে আমরা দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করতে পারব এবং স্থানীয় জনগণের জীবনের মান উন্নয়নে অবদান রাখতে পারব। এটি শুধু আমাদের বর্তমান প্রজন্মের জন্য নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি স্থিতিশীল এবং উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। 

দেশের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থান রক্ষা করতে হলে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষার বিকল্প নেই। বৈদেশিক পোশাক আমদানির শুল্ক কমানোর পরিবর্তে বর্তমানে দেশীয় শিল্পকে সহায়তা করার নীতি গ্রহণ করা উচিত। দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থানের জন্য দেশীয় উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা এবং উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নেয়া এখন সময়ের দাবি।

লেখক: শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


মানবকণ্ঠ/এফআই