Image description

২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর প্রথমবারের মতো নির্বাচনের আয়োজন করতে যাচ্ছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার। 

তবে এই নির্বাচন নিয়ে আছে ব্যাপক সংশয়। ২০২০ সালের নির্বাচনে ভূমিধস জয় পাওয়া নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী অং সান সু চি কারাগারে, দেশটির সবচেয়ে সফল রাজনৈতিক দলকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে আর ভূখণ্ডের প্রায় এক তৃতীয়াংশ হয় বিরোধপূর্ণ বা বিদ্রোহীদের হাতে আছে। সেই নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ হবে, কিন্তু খুব কম মানুষই তা বিশ্বাস করেন।

তিন ধাপের ভোটের আজ হচ্ছে প্রথম ধাপ। এরপর ১১ এবং ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপ। মোট ৩৩০টি টাউনশিপের মধ্যে ২৬৫টিতে ভোট হওয়ার কথা থাকলেও এসব এলাকার সবগুলোতেই জান্তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে এখনও ঘোষণা করা হয়নি ভোট গণনা এবং ফলাফলের তারিখ। 

এদিকে সামরকি জান্তা একটি নতুন নির্বাচন সুরক্ষা আইন করেছে। এই আইনের অধীনে নির্বাচন নিয়ে কোনো সমালোচনা করলেও সর্বনিম্ন তিন বছরের কারাদণ্ড আর এমনকি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে।

গত জুলাই থেকে শুরু করে ইতোমধ্যে দুই শতাধিক ব্যক্তিকে এই আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে এমন লোকও আছেন যারা সামাজিক মাধ্যমে ভোটকে সমালোচনা করা পোস্টে শুধু লাইক দিয়েছিলেন। ইয়াঙ্গুনের মতো শহরগুলোর বাসিন্দারা জানিয়েছেন, কর্তৃপক্ষ দ্বারে দ্বারে গিয়ে লোকজনকে ভোট দিতে যাওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়ে এসেছে।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, মানুষের হয়তো এসব নির্দেশনা মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না।

তারপরও সামরিক জান্তার দাবি, নির্বাচন জোর করে করা হচ্ছে না, এর প্রতি জনগণের সমর্থন আছে।

পশ্চিমা অনেক সরকার এবং জাতিসংঘ এই ভোটকে ‘ভান’ অভিহিত করে অগ্রহণযোগ্য বলে মত দিয়েছে। কিন্তু জান্তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র চীন এই নির্বাচনের প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে। ভাষ্যকাররা জানিয়েছেন, চীন এই ভোটকে স্থিতিশীলতার পথে ফিরে আসার সবচেয়ে ভালো উপায় হিসেবে বিবেচনা করছে।

জান্তার মুখপাত্র মেজর জেনারেল জাও মিন তুন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “নির্বাচন পরিচালিত হচ্ছে মিয়ানমারের জনগণের জন্য, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সন্তুষ্ট হলো কি হলো না, তা অপ্রাসঙ্গিক।”

নির্বাচনে নিবন্ধিত ৫৭টি দল অংশ নিচ্ছে। কিন্তু এসব দলের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কিত বা তাদের ওপর নির্ভরশীল বলে মনে করা হয়। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব দল কেবল পছন্দের বিভ্রম তৈরি করছে কিন্তু সামরিক শাসনের সত্যিকারের বিরোধিতার প্রতিনিধিত্ব করছে না।

এসব দলগুলোর মধ্যে মাত্র ছয়টি দেশজুড়ে যেখানে যেখানে ভোট হচ্ছে তার সবগুলোতে প্রার্থী দিয়েছে। এই ছয়টি দলের মধ্যে সামরিক বাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি ও ডেভলেপমেন্ট পার্টিও আছে। এরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রার্থী দাঁড় করিয়েছে আর বহু আসনে তাদের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার পথে আছেন।

অং সান সু চির দল, ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি, ২০২০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছিল, কিন্তু সে দলকে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। জান্তা সমর্থিত ইউনিয়ন ইলেকশন কমিশনের দাবি অনুযায়ী নিবন্ধিত হতে অস্বীকার করার পর দলটিকে ভেঙে দেওয়া হয়।

ব্যাংককভিত্তিক নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা আনফ্রেলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলগুলোর মধ্যে ৫৭ শতাংশের আর কোনো অস্তিত্ব নেই; যদিও এসব দল ওই নির্বাচনে সম্মিলিতভাবে ৭০ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছিল আর পার্লামেন্টের ৯০ শতাংশেরও বেশি আসন পেয়েছিল।

মিয়ানমারের বহু এলাকা নির্বাচনের বাইরে আছে। সম্প্রতি জান্তা বাহিনী লড়াইয়ে কিছুটা সাফল্য পেলেও এখনও বিশাল এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে আছে। ফলে ওইসব এলাকাও নির্বাচনের আওতার বাইরে থাকছে।

সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, দেশটির ৩৩০টি শহরের মধ্যে ৫৬টিতে ভোট হবে না। এর পাশাপাশি আরও তিন হাজার গ্রাম ও ওয়ার্ড এলাকা নির্বাচনের বাইরে আছে। বিশ্লেষকদের হিসাব অনুযায়ী, দেশটির প্রায় এক তৃতীয়াংশ নির্বাচনের বাইরে থাকছে।

ফলে ভোট অনেকটা রঙ হারিয়েছে। যে সব এলাকায় ভোট হচ্ছে সেখানেও নির্বাচনের উত্তাপ বা প্রাণ নেই।

বিবিসিকে এক নারী ভোটার বলেছেন, “নির্বাচনে আমরা ভোট দেবো, কিন্তু হৃদয় দিয়ে নয়।”