Image description

আগামী ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শুক্রবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি এ তথ্য জানান। বাংলাদেশ সময় রাত ৯টার পর দেওয়া এই ভাষণে তিনি গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সংস্কার, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, রোহিঙ্গা সংকট, গাজা পরিস্থিতি এবং বৈশ্বিক সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

জাতিসংঘের ভূমিকার প্রশংসা

জাতিসংঘ সনদের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে সব সদস্য রাষ্ট্রকে অভিনন্দন জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, "গত আট দশকে জাতিসংঘ বিশ্বশান্তি, মানবাধিকার, এবং জীবনমান উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। এর মাধ্যমে বিশ্বের ১২০টি দেশের প্রায় ১৩ কোটি মানুষ জরুরি খাদ্য ও মানবিক সহায়তা পাচ্ছে, এবং ৪৫ শতাংশ শিশু টিকা পাচ্ছে।" তিনি জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, স্যানিটেশন ও জীবনরক্ষাকারী সেবার ভূয়সী প্রশংসা করেন।

গণ-অভ্যুত্থান ও সংস্কারের অগ্রগতি

গত বছরের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রূপান্তর প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করে তিনি বলেন, "আমরা স্বৈরাচারমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত ও ন্যায়বিচারভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে কাজ করছি।" এ লক্ষ্যে ১১টি স্বাধীন সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে, যারা শাসনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন, জনপ্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা, দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রম ও নারী অধিকার ক্ষেত্রে সুপারিশ প্রদান করছে।

তিনি জানান, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের প্রতি টেকসই অঙ্গীকার তৈরি করা হয়েছে। "জুলাই ঘোষণা"র মাধ্যমে এই অঙ্গীকারকে সময়াবদ্ধ করা হয়েছে, যাতে আগামী নির্বাচনে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, সংস্কার অব্যাহত থাকবে।

অর্থনৈতিক সংস্কার ও সম্পদ পুনরুদ্ধার

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সুশাসন, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই উন্নয়ন বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কৌশলের মূল ভিত্তি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের কঠোর সমালোচনা করে তিনি পাচার হওয়া শত শত কোটি ডলার ফেরত আনাকে সরকারের শীর্ষ অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেন।

ড. ইউনূস বলেন, "বিগত দেড় দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, জবাবদিহি ছাড়া যেকোনো উন্নয়ন ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর। রাজনৈতিক হীনস্বার্থ ও দুর্নীতির উদ্দেশ্যে গৃহীত অবকাঠামো প্রকল্প শুধু অর্থনীতির ওপর চাপই বাড়ায়নি, জনগণের কোনো কল্যাণও করেনি।" তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিগত সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি ও জনগণের সম্পদ চুরির বিস্তৃতি আবিষ্কার করেছে, যা দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থাকে ভয়ানক নাজুক ও ভঙ্গুর করে ফেলেছে।

প্রধান উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেন, "পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার বর্তমান সরকারের অন্যতম শীর্ষ অগ্রাধিকার।" তিনি উল্লেখ করেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এই সম্পদ ফেরত আনার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চলছে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনি জটিলতা ও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, "সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দৃঢ় সদিচ্ছা ছাড়া এই অবৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।"

ড. ইউনূস যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান পাচার হওয়া সম্পদ গচ্ছিত রাখার সুযোগ দিচ্ছে, তাদের এই অপরাধের শরিক না হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, "এই সম্পদ প্রকৃত মালিক অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ করদাতাদের কাছে ফিরিয়ে দিন।" তিনি উন্নয়নশীল দেশ থেকে সম্পদ পাচার রোধে কঠোর আন্তর্জাতিক বিধিবিধান প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে সুশাসন, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, "আমরা এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাই, যা জনগণের কল্যাণে কাজ করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হবে।" তিনি জোর দেন, জবাবদিহিহীন উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, যা জনগণের জন্য ক্ষতিকর।

জাতিসংঘের মঞ্চ থেকে দেওয়া এই বক্তব্যে ড. ইউনূস বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন, যা দেশের সাধারণ মানুষের জন্য একটি আশার বার্তা বহন করে।

মিথ্যা সংবাদ ও অপপ্রচার

বর্তমানে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা এবং ঘৃণাত্মক বক্তব্য গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক ইউনূস। গত বছর বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ের উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভ্রান্তিকর সংবাদ ছড়ানো হয়েছে, যা এখনো চলমান। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরিকল্পিত মিথ্যা সংবাদ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ‘ডিপফেক’–এর প্রসার। যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এসবের বিরুদ্ধে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যাতে এসব বিকৃত কর্মকাণ্ড মানুষের ওপর মানুষের আস্থাকে বিনষ্ট না করে এবং সামাজিক সম্প্রীতিকে দুর্বল না করে।

রোহিঙ্গা সংকট

প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে চলমান সংঘাত সমগ্র অঞ্চলের জন্য এক গভীর উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে বলে মন্তব্য করেন মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, এটি শুধু আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেই ঝুঁকিতে ফেলছে না; বরং বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়া বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনকেও কঠিন করে তুলেছে।

গত আট বছরেও রোহিঙ্গা সংকটের কোনো সমাধান দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না এবং বাংলাদেশ প্রতিনিয়তই মিয়ানমার থেকে আগত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হচ্ছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা।

রাখাইনে সাংস্কৃতিক পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতির কারণে রোহিঙ্গাদের ওপর অধিকারবঞ্চনা ও নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রান্তিকীকরণের প্রক্রিয়া আর চলতে দেওয়া যাবে না। যেসব বৈষম্যমূলক নীতি ও কর্মকাণ্ড আজকের এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে, তার সমাধান এবং প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করা সম্ভব। রাখাইনের সমস্যাগুলোর চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক সমাধান করাও অপরিহার্য।

মিয়ানমারের সংকটের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী রোহিঙ্গারা এবং বাংলাদেশ বলে মন্তব্য করেন সরকারপ্রধান। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকট কোনোভাবেই মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো দ্বিপক্ষীয় বিষয় নয়। বাংলাদেশ শুধু একটি দায়িত্বশীল প্রতিবেশী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীল সদস্য হিসেবে মানবিক দায়িত্ব পালন করে আসছে। কিন্তু তহবিল–সংকটের কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখার যৌথ প্রয়াসও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি তাদের জরুরি সহায়তা কার্যক্রমে মারাত্মক তহবিলঘাটতির বিষয়ে ইতিমধ্যে সতর্ক করেছে। অবিলম্বে নতুন তহবিল না এলে, মাসিক রেশন অর্ধেকে নামিয়ে এনে মাথাপিছু মাত্র ৬ মার্কিন ডলারে নামতে পারে।

অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, তহবিলের অতিরিক্ত কাটছাঁট হলে তা নিঃসন্দেহে সুরক্ষা ও নিরাপত্তাঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি করবে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সীমানা ছাড়িয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে বিদ্যমান দাতাদের সাহায্য বাড়াতে এবং সম্ভাব্য নতুন দাতাদের অনুদান প্রদানের আহ্বান জানান তিনি।

গাজা পরিস্থিতি

গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যার কথা উল্লেখ করে শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ইউনূস বলেন, শিশুরা না খেয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করছে, বেসামরিক জনগোষ্ঠীকে নির্বিচার হত্যা করা হচ্ছে। হাসপাতাল, স্কুলসহ একটি গোটা জনপদ নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হচ্ছে। জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সঙ্গে একমত যে সবার চোখের সামনেই একটি নির্বিচার গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। দুর্ভাগ্য যে মানবজাতির পক্ষ থেকে এর অবসানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও ইতিহাস ক্ষমা করবে না।

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের জন্য বাংলাদেশের জনগণ ও বিশ্বের বিবেকবান নাগরিকদের পক্ষ থেকে জোরালো দাবি জানিয়ে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান বলেন, শিশু ও বেসামরিক নাগরিকদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। এটি একটি নির্বিচার গণহত্যা।" তিনি পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের দাবি জানান।

বাংলাদেশের রূপান্তরের বার্তা

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, "বাংলাদেশের ইতিহাস সাধারণ মানুষের অসাধারণ ক্ষমতার প্রমাণ। জুলাই অভ্যুত্থানে তরুণরা স্বৈরাচারকে পরাভূত করেছে। এই রূপান্তর বিশ্বের সব দেশে আশার সঞ্চার করবে।" তিনি জোর দিয়ে বলেন, কোনো সংকটই অমীমাংসিত নয়, এবং বাংলাদেশ সেই পথে এগিয়ে চলছে।

এই ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি), বিটিভি নিউজ ও বাংলাদেশ বেতারে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।