
দেশের ৭৬ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার স্বামীর হাতে সহিংসতার শিকার হয়েছেন। সে হিসাবে প্রতি চার নারীর মধ্যে তিনজনকে এ সহিংসতা সইতে হয়েছে। সহিংসতার ধরনের মধ্যে আছে– শারীরিক, মানসিক, যৌন, অর্থনৈতিক ও নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ। সহিংসতার শিকার হলেও ৯৩ শতাংশ নারীই প্রতিকারমূলক কোনো আইনি পদক্ষেপের পথে হাঁটেননি। ৬২ শতাংশ নারী সহিংসতার কথা কখনও প্রকাশই করেননি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ প্রতিবেদনে নারীর সামাজিক বিপন্নতার এ চিত্র উঠে এসেছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এক অনুষ্ঠানে জরিপের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪’ শিরোনামে এটি পরিচালনায় সহায়তা দিয়েছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল-ইউএনএফপিএ। অনুষ্ঠানে এর বিস্তারিত তুলে ধরেন প্রকল্প পরিচালক মিনাক্ষী বিশ্বাস।
জাতিসংঘের স্বীকৃত পদ্ধতিতে দেশের খানাভিত্তিক শহর, গ্রাম, দুর্যোগপ্রবণ, বস্তি এলাকাসহ ২৭ হাজার ৪৭৬ নারীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। তথ্য সংগ্রহ করা হয় গত বছরের মার্চ থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে।
গর্ভাবস্থায়ও সহিংসতা থেমে থাকেনি
জরিপে জাতিসংঘের নির্ধারিত সহিংসতার ধরন ছাড়াও বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক আচরণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে জরিপের সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়। জরিপে আরও দেখা যায়, ৫৪ শতাংশ অর্থাৎ অর্ধেকের বেশিসংখ্যক নারী জীবদ্দশায় স্বামীর হাতে শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। গর্ভাবস্থাতেও এ সহিংসতা থেমে থাকেনি। গর্ভ অবস্থায় ৭ দশমিক ২ শতাংশ নারী শারীরিক ও ৫ দশমিক ৩ শতাংশ যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তির সহিংসতাও
নারীর প্রতি শারীরিক সহিংসতার বাইরে প্রযুক্তির সহিংসতাও যুক্ত হয়েছে। ৮ দশমিক ৩ শতাংশ নারী প্রযুক্তির মাধ্যমে জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে যৌন ব্ল্যাকমেইল, ছবি অপব্যবহার এবং ডিজিটাল নজরদারি। সহিংসতার শিকার নারীরা অর্থ ব্যয় এবং সামাজিক ভয়ে চিকিৎসা নেন না। জরিপ থেকে দেখা যায়, ৫২ শতাংশ নারী জানেন না কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়।
প্রধান কারণ যৌতুক
নারীর প্রতি সহিংসতার মূল কারণ যৌতুক প্রথা। এ ছাড়া স্বামীর মাদকাসক্তি, বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক ও শহুরে বস্তিতে বসবাস নারীদের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। অন্যদিকে, স্বামীর উচ্চতর শিক্ষা সহিংসতার আশঙ্কা কমায়।
সহিংসতা আগের তুলনায় ১৭ শতাংশ কমেছে
জরিপে নারীর প্রতি সহিংসতা এখনও উচ্চ মাত্রায় রয়ে গেলেও আগের তুলনায় তা কিছুটা কমেছে। স্বামীর হাতে সহিংসতার শিকার নারীর হার ২০১৫ সালের জরিপে ছিল ৬৬ শতাংশ। সেখান থেকে কমে বর্তমানে ৪৯ শতাংশ হয়েছে।
আলোচনায় সব পক্ষকে দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ
সহিংসতা রোধে সব পক্ষকে আরও দায়িত্বশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আলোচকরা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি পরিকল্পনা কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য ড. কাইয়ুম আরা বেগম বলেন, সামাজিক দায়িত্বহীনতা থেকেই অস্থিরতা ও সহিংসতা সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র ও পরিবারকে সহিংসতা বন্ধে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
ইউএনএফপিএ বাংলাদেশ প্রতিনিধি ক্যাথরিন ব্রিন কামকং বলেন, পরিসংখ্যানগুলো বাংলাদেশে নারীর বাস্তব চিত্র তুলে এনেছে। এগুলো শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং বাংলাদেশের মর্যাদার প্রশ্ন।
Comments