Image description

বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশেষ করে ফেইসবুকে সহিংসতা উসকে দেওয়া, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং মব অ্যাকশনের (গণপিটুনি বা বিশৃঙ্খলা) আহ্বান ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতীয় সাইবার সুরক্ষা এজেন্সি (এনসিএসএ)। উদ্ভূত পরিস্থিতিকে জাতীয় নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার জন্য চরম হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে সংস্থাটি মেটা (ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপের মূল প্রতিষ্ঠান) কর্তৃপক্ষকে একটি জরুরি ও বিস্তারিত চিঠি পাঠিয়েছে।

গত শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) এনসিএসএ-র মহাপরিচালক মেটার শীর্ষ কর্মকর্তাদের কাছে এই আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠান। চিঠির প্রাপকদের মধ্যে রয়েছেন- মেটার ভাইস প্রেসিডেন্ট (পাবলিক পলিসি) সাইমন মিলনার, আঞ্চলিক কার্যালয়ের পাবলিক পলিসি পরিচালক সারিম আজিজ এবং হেড অব হিউম্যান রাইটস পলিসি ফ্রেডেরিক রসকি। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সংবাদমাধ্যমকে এই চিঠি পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

চিঠিতে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০২৪ সালের জুলাই মাসের গণঅভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০-এর বেশি শিক্ষার্থীর আত্মত্যাগ ও হাজার হাজার মানুষের আহতের মধ্য দিয়ে দেশটি একটি রূপান্তরের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বর্তমানে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে এবং একটি বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এই ভঙ্গুর ও সংকটময় সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত সংবেদনশীল।

এনসিএসএ-র অভিযোগে বলা হয়েছে, বর্তমান অস্থিতিশীলতাকে পুঁজি করে ফেইসবুকসহ মেটার প্ল্যাটফর্মগুলো সহিংসতা উসকে দেওয়ার অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন ব্যাহত করার আহ্বান এবং বাস্তব জীবনের সহিংসতা বাড়াতে এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে ইনকিলাব মঞ্চের অন্যতম নেতা ওসমান হাদির মর্মান্তিক মৃত্যু এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর হামলার ঘটনাকে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, সাবেক শাসনব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত কিছু ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে প্রকাশ্যে সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে সহিংসতার আহ্বান জানিয়েছেন। এর পরপরই ‘দ্য ডেইলি স্টার’ ও ‘প্রথম আলো’র কার্যালয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের মতো বর্বরোচিত ঘটনা ঘটে। এনসিএসএ ক্ষোভের সঙ্গে জানিয়েছে যে, এসব সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য দায়ী হিসেবে চিহ্নিত একাধিক অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয় করার অনুরোধ জানানো হলেও মেটা কর্তৃপক্ষ সময়মতো পর্যাপ্ত সহযোগিতা করেনি।

সংস্থাটি মনে করে, সহিংস কনটেন্টের অনিয়ন্ত্রিত প্রচার জাতীয় স্থিতিশীলতা, সামাজিক সম্প্রীতি, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য সরাসরি হুমকি। মেটার ভূমিকা কেবল একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি বড় ধরনের ‘গণদায়িত্ব’ (Public Responsibility) বলে চিঠিতে মন্তব্য করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে মেটার কোনো স্থানীয় কার্যালয় না থাকায় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো বিটিআরসি, তথ্য মন্ত্রণালয় ও এনসিএসএ-র মাধ্যমে মেটার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে।

পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় মেটাকে চিঠিতে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে:

১. দায়িত্ব স্বীকার: সহিংসতা ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা রোধে নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের ক্ষেত্রে মেটাকে দায়বদ্ধ থাকতে হবে।
২. কঠোর প্রয়োগ: বাংলাদেশ-সংক্রান্ত বিতর্কিত কনটেন্টে মেটার ‘কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড’ আরও কঠোরভাবে এবং দ্রুততার সঙ্গে প্রয়োগ করতে হবে।
৩. মডারেশন জোরদার: বাংলা ভাষায় কনটেন্ট মডারেশন (তদারকি) ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে এবং ‘সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস’ বা জনমতের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ জোরদার করতে হবে।
৪. নির্বাচন পর্যন্ত নজরদারি: অন্তত ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত জাতীয় নির্বাচন সফলভাবে সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ-সংক্রান্ত সকল কনটেন্টের ওপর বিশেষ ও বাড়তি নজরদারি বজায় রাখতে হবে।

চিঠিতে শেষান্তে বলা হয়েছে, দীর্ঘ ১৭ বছর পর বাংলাদেশ একটি প্রকৃত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অপেক্ষায় রয়েছে। এই নির্বাচনটি নাগরিকদের জীবন, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং দেশের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। এই জাতীয় গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে মেটা যথাযথ দায়িত্ববোধ ও জরুরি মনোভাব নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে জাতীয় সাইবার সুরক্ষা এজেন্সি।