Image description

বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিপূর্ণ দুটি দেশ। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে, দেশ দুটি যোগাযোগ, ব্যবসা, বাণিজ্য, অর্থনীতি একটি অপরটির উপর নির্ভরশীল। এছাড়াও দেশ দুটির মাঝে ইতিহাস, ভাষা, ঐতিহ্য এবং শিল্পকলা সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে মিল রয়েছে। বাংলাদেশের তিন দিক থেকে ঘিরে আছে ভারত সীমান্ত, শুধু দক্ষিণের সামান্য বর্ডার মিয়ানমারের সাথে ভাগ করেছে বাংলাদেশ। বাকি অংশ পুরোটাই বঙ্গোপসাগর। 

বাংলাদেশ ও ভারত শুধু ভৌগোলিক সীমান্ত সম্পর্কেই আবদ্ধ নয়, বরং দুই দেশ অর্থনীতি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, শিক্ষা, ব্যবসা, বাণিজ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ নানা ক্ষেত্রে পরস্পর এক দেশ অপর দেশের উপর নির্ভর করে। ভারতের মিত্র সরকার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বর্তমান সময়ে দেশ দুটির মাঝে সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। এতে দেশ দুটির মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্কে ফাটল ধরার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ইতোমধ্যেই।

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের সূচনা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া ২য় দেশ ভারত। শুধু স্বীকৃতি নয়! স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ জন্মের সম্পূর্ণ কৃতিত্বের সবচেয়ে বড় অংশীদার ভারত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কয়েকটি বিদেশি রাষ্ট্র এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। এরমধ্যে ভারত অন্যতম। পাক-বাহিনীর অত্যাচারে প্রায় এক কোটি বাঙালি ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারত সরকার এসব উদ্বাস্তুদের খাদ্য, বস্ত্র, ঔষধ দিয়ে সাহায্য করে। 

বাংলাদেশকে সহযোগিতার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী পাক-বাহিনীর নির্যাতন-হত্যার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টিতে বেশ জোরালো ভূমিকা পালন করে ভারত। যুদ্ধকালীন সময়ে ভারত মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং, অস্ত্র, খাবার দিয়ে সহযোগিতা করে। যুদ্ধের প্রথম দিক থেকেই ভারত বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দিয়ে আসছিল। এরপর  ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার একটি যৌথবাহিনী গঠন করে। ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে  মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করে।

বাংলাদেশিরা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের অবদানকে গভীরভাবে স্মরণ করলেও ভারতের আগ্রাসনের অভিযোগ তুলেছেন দীর্ঘদিন ধরে। বাংলাদেশের মানুষের অভিযোগ, স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে ভারত। ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য বিভিন্ন সময় প্রভাবিত করেছে। বাংলাদেশের ক্রাইসিস মুহূর্তে সংকটে পড়া পণ্য ভারত রপ্তানি করা বন্ধ করে দিয়েছে। এতে করে চরম বিপাকে পড়েছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও ক্রেতারা। বাজারে তৈরি হয়েছে অস্থিরতা। 

এছাড়াও ভারত অভিন্ন ৫৪টি নদীর মধ্যে ৪৭টি নদীর গতিপথে ছোট-বড় ৫ শতাধিক বাঁধ নির্মাণ করেছে। ভারতের দেয়া বাঁধের কারণে নদীর প্রবাহ চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের নদ-নদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাচ্ছে, আবার বর্ষা মৌসুমে পানি ছেড়ে দেয়ায় উজানি ঢলে বাংলাদেশে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক ও মৎস্য সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার এসব নদীতে বাঁধ নির্মাণের সময় এতে ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহতের কারণ সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ভারত সরকার এসবের কর্ণপাত করেনি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ ভারতের ফারাক্কা বাঁধ। 

ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশ দুইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রথমত শুকনো মৌসুমে বাংলাদেশ যথেষ্ট পরিমাণে পানি পায় না। আবার বন্যার মৌসুমে ভারত অন্যায়ভাবে বাঁধ খুলে দেয়। এই পানিতে নদীর ভাঙন বেড়ে যায় ফলে গ্রামের পর গ্রাম নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। হাজার হাজার একর কৃষি জমি নষ্ট  হয়ে যায়। এদিকে বিভিন্ন সময় সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশিরা প্রাণ হারায়। তাছাড়া ভারত একতরফাভাবে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকানোর কথা তারা বেশি বলছে। অথচ ভারতের মানুষও দেদারছে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। কাঁটাতারের বেড়ার এই পাশে থাকলেও তারা বাংলাদেশিদের হত্যা করতে পিছপা হচ্ছে না। একের পর এক গুলি ছুড়ে কাঁটাতারের এ পাশের কৃষক ও রাখালদের হত্যা করছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)।

বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য রপ্তানির একটি উল্লেখযোগ্য অনুপাত শ্রমনির্ভর পণ্য নিয়ে গঠিত। সে কারণে তাদের চাহিদার ওপর বিরূপ প্রভাব শুধুমাত্র রপ্তানি আয়ের ক্ষতিই নয় বরং ভারতীয় শ্রমিকদের চাকরির বাজারেও প্রভাব ফেলবে। দুই দেশের অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। যে শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তা হলো টেক্সটাইল এবং পোশাক যা বাংলাদেশে ভারতের মোট পণ্য রপ্তানির প্রায় ২৪ শতাংশ। তাই দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি দুই দেশের অর্থনীতিতে শক্তিশালী আঘাত হানবে। ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের প্রতিবেশী সব দেশের সাথে ভারতের শত্রুতা রয়েছে। শুধু বাংলাদেশ ও ভুটান বাদে। 

ভারতের বিরোধ রয়েছে প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কার সাথে, পাকিস্তান ও চীনের সাথে সীমান্তে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিবেশ থাকে সব সময়, নেপালের সাথেও খুব একটা ভালো সম্পর্ক না ভারতের। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের বাংলাদেশ ও ভুটানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। যদি কখনো বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের অবনতি হয়! তাহলে ভৌগলিক অবস্থানের বিবেচনায় ভারত বেশ চাপে পড়ে যাবে। সেই সাথে সবগুলো প্রতিবেশী দেশের সাথে শত্রুতা থাকার সুযোগে এবং বাংলাদেশের ভেতরে দিয়ে দ্রুত সময়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগ ব্যাহত হওয়ার কারণে সেখানকার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। নানামুখী চাপে ভারত ওই সকল রাজ্যগুলো নিজেদের মানচিত্র থেকে হারিয়ে ফেলতে পারে। তাই বাংলাদেশের যেমন প্রয়োজন ভারতকে তেমনি ভারতেও প্রয়োজন বাংলাদেশকে। যেহেতু, ভৌগলিক অবস্থানের জন্য? বাংলাদেশ ও ভারত পারস্পরিক একে অপরের উপর নির্ভরশীল তাই দুটি দেশের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কোনো বিকল্প নেই। 

সাম্যতা ও দুটি দেশের স্বার্থকে সমানভাবে প্রাধান্য দিয়ে নতুন করে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ব্যবসা ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। দুই দেশের মধ্যে পানিবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর অনুযায়ী নদীর পানি বণ্টন করতে হবে। সীমান্তে বিএসএফের নিরীহ বাংলাদেশিদের ওপর গুলিবর্ষণ বন্ধ করতে হবে। একটি দেশ অপরটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। দুটি দেশের সরকারের ও সাধারণ মানুষের ভারত বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উন্নতি চাওয়াই কাম্য হোক।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


মানবকণ্ঠ/এফআই