Image description

খুচরা বাজারে প্রতি কেজি আলু ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি আছে। কৃষক বর্তমানের আলু বিক্রি করছেন প্রতি কেজি ১৮ থেকে ২২ টাকায়। কারণ কৃষকের আলু পাইকাররা কিনে নিচ্ছে। পাইকারদের কাছ থেকে খুচরা বিক্রেতা, আর খুচরা বিক্রেতা বিক্রি করে ভোক্তার কাছে । তাই কৃষক প্রতি কেজি আলুতে সাত থেকে আট টাকা কম পায় ভোক্তার মূল্যের চেয়ে। বর্তমানে এক শ্রেণির মজুতকারী কৃষকের কাছ থেকে আলু কিনছে, এবং তারা কোল্ড স্টোরেজে বা হিমাগারা এই আলু রেখে দিচ্ছে, যখন সাধারণ কৃষকের বিক্রির আর আলু থাকবে না, তখন তারা সিন্ডিকেট করে আলুর দাম বাড়িয়ে দিবে।

এ বছর আলুর প্রতি কেজি ৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এই ৮০ টাকা কেজি মূল্যের আলুর উৎপাদনকারী একজন কৃষক। এই কৃষক প্রতি কেজি আলুর দাম কত পেল। ১৮ থেকে ২২ টাকা পেল কৃষক আর বাকি টাকাটা চলে গেল যাদের পকেটে তারা সমাজের কথিত প্রভাবশালী মানুষ। এই প্রভাবশালী গোষ্ঠীর দখলে রয়েছে আলুর কোল্ড স্টোরেজ। তাই তারা এই লাভটা করতে পারছে। বর্তমানে ভরা মৌসুমে কৃষক প্রতি কেজি পেঁয়াজের মূল্য পাচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। প্রান্তিক কৃষকের পেঁয়াজ মজুত করে রাখার বা সংরক্ষণ করার মতো কোনো ব্যবস্থা নাই। তাই মাঠ থেকে পেঁয়াজ উঠার পর তাকে পেয়াজ বিক্রি করে দিতে হয়। 

অনুরূপভাবে আদা হলুদ, রসুনসহ সকল প্রকার কৃষি পণ্যই কৃষককে মাঠ থেকে তোলার পর পর বিক্রি করতে হচ্ছে। তাই দেখা যায় একজন কৃষক তার উৎপাদন খরচের সাথে সঙ্গতিপূর্ণতায় কৃষি পণ্যের দাম পাচ্ছে না। বর্তমানে খোলা বাজারে সারের মূল্যটার দিকে একটু নজর দিলে দেখা যায়, ইউরিয়া ৩০ থেকে ৩২ টাকা (সরকার নির্ধারিত মূল্যে কৃষক সার কিনতে পারে না), ডিএপি ২৫ থেকে ২৮ টাকা, টিএসপি ৩২ থেকে ৩৪ টাকা, এমওপি ২২ থেকে ২৫ টাকা করে কিনতে হচ্ছে। 

বর্তমানে কোন ফসল ফলাতে গেলে কৃষককে বাধ্য হয়েই রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হয়। বিদ্যুৎ এর দাম বাড়ার কারণে সেচের মুল্য বেড়ে গেছে। বর্তমানে সেচ ছাড়া ফসল হয় না। কৃষকেরা এখন আর আগের মত লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষ করেন না। তাকে চাষের জন্য ব্যবহার করতে হয় ট্রাক্টর, প্রান্তিক পর্যায়ের কোন কৃষকের ট্রাক্টর নেই তাকে ঘণ্টা চুক্তিতে ট্রাক্টর ভাড়া করে এনে জমি চাষ করতে হয়। এক কেজি আলু বা পেঁয়াজ উৎপাদনে কৃষকের যে উৎপাদন খরচ পরে তাতে একজন কৃষক কেজি প্রতি এক থেকে দুই টাকা লাভ পায় উৎপাদন খরচ বাদে। 

একজন প্রান্তিক কৃষক বছরে ১০০ থেকে ৫০০ কেজির বেশি আলু বা পেঁয়াজ উৎপাদন করতে পারেন না। তাহলে তার উৎপাদন বছরে শেষে কত টাকা লাভ থাকছে তা হিসেব করলে দেখা যায়, এক থেকে তিন হাজার টাকা। এই টাকাটা তিনি পান তিন মাস শ্রম বিনিয়োগ করে, সেই হিসাবে তার মাসিক আয় কত হয় ( যদিও আলুর বা পেঁয়াজ উৎপাদনের সময়টায় কৃষক তার শ্রম ধান বা অন্য ফসল উৎপাদনে বিনিয়োগ করেন), তবে যতই অন্য ফসলে তার শ্রম বিনিয়োগ হোক না কেন, তিনি যা আয় করেন তা বর্তমান বাজার মূল্য হিসাবে  শ্রমমূল্যটা অনেক অনেক কম। রাজশাহীর সাহেব বাজারে এক কেজি ওজনের একটি ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ টাকায়, বাঁধাকপি, ব্রুকলি, মুলা গাজরসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের বাজারমূল্য নিন্মমুখী। 

এই সবজিজাত কৃষিপণ্য উৎপাদন করে কৃষক তার শ্রমের মূল্যটা ঠিকঠাক মতো পান না। চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী, এখন কিন্তু কৃষকের কাছে ধান নাই। কারণ কার্তিকের শেষের দিক থেকে শুরু করে অগ্রহায়ণের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষকের হাতে ধান থাকে। ঐ সময়টায় কৃষকেরা ধান বিক্রি করে দেন, তখন ফড়িয়া বা পাইকাররা কৃষকদের ধানের ন্যায্যমূল্য দেয় না। ফসল উঠার সাথে সাথে কৃষক ধান বা অন্য ফসল বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন এই কারণে, তার ফসল উৎপাদনের খরচের টাকাটা তিনি নিয়েছেন। আর এই ঋণ  পরিশোধ করার জন্য তিনি ফসলটা বিক্রি করে দেন। কৃষক বর্তমানে এনজিও ও মাহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নেয়।

এই চড়া সুদের ঋণ নেয়ার কারণ কৃষককে কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ দেয় না। যদিও বর্তমানে কৃষিব্যাংকসহ অন্যান্য কিছু ব্যাংক কৃষকদের সরাসরি ঋণ দিচ্ছে, তবে এই ঋণ পাওয়ার ঝক্কি ঝামেলা অনেক। একজন প্রান্তিক কৃষককে কৃষিব্যাংক থেকে ঋণ পেতে হলে, তাকে যে কাগজপত্র জমা দিতে হয়, তা হলো হাল নাগাদ জমির খাজনার রশিদ, জমির দলিল, এই জমির তিন গ্রহীতার হস্তান্তরকৃত দলিল দিতে হয়। এই সমস্ত কাগজপত্র সংগ্রহ করা একজন কৃষকের জন্য কষ্টসাধ্য বিষয়। কারণ, ধরা যাক এক্স নামক একজন কৃষক এক বিঘা জমি ক্রয় করলেন ওয়াই নামের এক ব্যক্তির কাছ থেকে, ওয়াই নামক ব্যক্তি এই জমিটি কিনেছেন জেড নামক ব্যক্তির কাছ থেকে, জেড নামক ব্যক্তি কিনেছে আলফা নামক আরেকজনের কাছ থেকে। 

এখন কৃষিব্যাংক থেকে এক্স নামক কৃষক ঋণ পেতে হলে তাকে ওয়াই, জেড নামক ব্যক্তিরা যে দলিল মূলে কিনেছে, সেই দলিল নকল ব্যাংকে জমা দিতে হবে। এর কারণ সে যে ওয়াইর কাছ থেকে কিনেছে তার ধারাবাহিকতা ঠিক আছে কিনা তা যাচাই করেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।  আর এই দলিলগুলো এক্সের কাছে থাকে না। তাই দলিলগুলোর নকল এক্সকে তুলতে হয় সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে। আর এই দলিল তোলা মহা ঝামেলার বিষয়। কারণ দুই মাসের নিচে কোনো দলিলের নকল পাওয়া যায় না। এতদ সমস্ত কাগজ পত্রাদি জোগাড় করে একজন প্রান্তিক কৃষকের আর কৃষিব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া সম্ভব হয় না। 

তাই তিনি বাধ্য হয়ে চড়া সুদে মহাজন বা এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে নেন। এবং ফসল প্রাপ্তির সাথে সাথে তা বিক্রি করে ঐ ফসল উৎপাদনের জন্য গ্রহণ করা ঋণটা পরিশোধ করতে হয়, আর এই কারণেই ফসলের ন্যায্যমূল্য প্রান্তিক কৃষক পায় না। ফলে প্রান্তিক কৃষকের ভাগ্যটা শূন্যই থেকে যায়, সে যতই ফসল ফলাক না কেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৪ বছর। এই ৫৪ বছরের দেশে অনেক পরির্বতন এসেছে। রস্তাঘাট, অফিস আদালত বেড়েছে বহুগুণ। কিন্তু একজন প্রান্তিক কৃষকের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করার বিষয়টা সহজ হয়নি। তা এখনো সেই ব্রিটিশ লাল ফিতায় আবদ্ধ। 

৫৪ বছরের পরির্বতন এসেছে বহু কিছুর, এখন কৃষক পাকা রাস্তায় হাটে যায়, ব্যাটারিচালিত অটোতে উঠে, কৃষক চড়া মূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে পারছে, তার ঘরে ইলেক্ট্রিক বাতি জ্বলে। তবে তার উৎপাদিত শস্য সংরক্ষণের জন্য ইউনিয়ন বা ওয়ার্ড পর্যায়ে গড়ে উঠেনি সরকারি সংরক্ষণাগার। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এসে কৃষককে দেখতে হচ্ছে ৪৭ এর আগের শাসন, অথচ ৭১ সালে এই কৃষকের আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে দেশ স্বাধীন হয়। একজন কৃষক ঋণ পেতে হলে ১০ লাখ টাকার জমি ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে পায় ৩০ হাজার টাকা। 

অপরদিকে সালমান এফ রহমানরা ২৫ লাখ টাকার সম্পদ দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা ঋণ পায় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে। এই ব্যবস্থার জন্য এদেশের কৃষকরা মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি। তারা চেয়েছিল দেশ স্বাধীন হবে, হবে সাম্যের বাংলাদেশ। তাই এই বৈষম্যের নিরসন করাটা জরুরি। দেশের ৫৬ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে কৃষির সাথে জড়িত। অথচ তারাই নানা শোষণ বঞ্চনার শিকার। কৃষকের প্রতি যে বৈষম্য বিরাজমান, সেই বৈষম্য নিরসন করতে হলে সমতা, সাম্য, সমাধিকারের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর বাইরে কিছু করলে বৈষম্য বার বার ফিরে আসবে।  

লেখক : কলামিস্ট