Image description

মহান রাব্বুল আল আমিন আল্লাহতায়ালা মানব জাতির কল্যাণের জন্য দানস্বরূপ যেসব রাত্রি নির্ধারণ করেছেন তন্মধ্যে ‘শবেবরাত’, ‘শবেকদর’, ‘শবেমেরাজ’ ইত্যাদি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। 

আরবি শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাতকে ‘শবেবরাত’ বা ভাগ্য রজনী বলা হয়ে থাকে। ‘শব’ ও বরাত’ এই শব্দ দুটি ফারসি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত, ‘শবেবরাত’ শীর্ষক শব্দটির সহজ অর্থ হলো ভাগ্য রজনী বা ভাগ্য নির্ধারণের এক বিশেষ রাত। সমস্ত পৃথিবীর মুসলামান সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত ধর্মীয় বিশ্বাস হলো আরবি চান্দ্রমাসের অষ্টম মাস হলো ‘মাহে শাবান’-এর ১৪ তারিখ দিবাগত রাত্রে বিশ্বস্রষ্টা মহান আল্লাহ তাঁর সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য পূর্বাহ্নে স্থিরীকৃত ফয়সালাসমূহ তথা তকদির থেকে সৃষ্টির জন্য পরবর্তী এক বছরের অবধারিত ফেরেস্তাদের কাছে  হস্তান্তর করে।

প্রত্যেক মুসলমানের জীবনে এ রাত্রির গুরুত্ব অপরিসীম। কু-প্রবৃত্তিজাত ষড়রিপুর তাড়নায় মানুষ বিপথগামী হয়ে থাকে এবং কোরআন ও হাদিসের নির্দেশ লঙ্ঘন করে পাপাচারে লিপ্ত হয়ে থাকে। কিন্তু মহান আল্লাহ করুণাময়, ক্ষমতাশীল এবং দয়ালু। তার কাছে ক্ষমা চাইলে তিনি ক্ষমা করে দেন। সাহায্য চাইলে সাহায্য করেন। তাই পাপীতাপীদের ক্ষমা চাওয়া ক্ষমা পাওয়ার সুযোগ দানের জন্য ‘শবেবরাত’, ‘শবেকদর’ দুটি বিশেষ রাতকে পুণ্যময় ও ক্ষমার মহিমায় ভাস্বর রাত হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে শাবান মাসের ১৫তম রাত শবেবরাত অন্যতম পুণ্যময় রাত। 

পবিত্র এই রাতে মুসলিম জাতি আল্লাহর এবাদত বন্দেগির মাধ্যমে পাপ থেকে মুক্তির জন্য পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার নিকট কৃপা প্রার্থনা করে থাকেন। রাতভর নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, আল্লাহর জিকির, কবর জিয়ারত ও দান খয়রাত প্রভৃতি পুণ্যময় কাজের মধ্য দিয়ে তারা এই রাত অতিবাহিত করে থাকেন। গুরুত্বপূর্ণ এই রাতে সারা বছরের মৃত্যু তালিকা প্রণয়ন করে (মৃত্যুর ফিরিস্তি) আজরাইল (আ.)-এর কাছে প্রদান করা হয়। এ রাতে নির্ধারণ হয় মানুষের জন্ম, রিজিক, সুখ, দুঃখ, সম্পদ, সম্মান ও অসম্মানের পরিমাণ। বান্দাহর আমলনামাও (বিগত বছরের পাপ-পুণ্যের হিসাব) আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। 

এ রাতেই মৃত ব্যক্তিদের আত্মারা পৃথিবীতে আসার অনুমতি পান। নিঝুম এ রাতের কোনো এক মুহূর্তে গাছ, বৃক্ষ, তরুলতা, পাহাড়, পর্বত, আল্লাহতায়ালার উদ্দেশ্যে সেজদায় পড়ে যায়। গউছুল আজম বড়পির আব্দুল ক্কাদির জিলানি (রা.) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘গুনয়াতুত তালেবীন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্ত্রী হজরত আয়েশা সিদ্দিকি (রা.)-কে বলতে শুনেছেন-বছরের বিশেষ চারটি রাতে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর মানুষের জন্য তার রহমতের দরজা খুলে দেন। এ রাতগুলোতে মাগরিবের পর থেকে ফজরের নামাজ পর্যন্ত সর্বক্ষণই আল্লাহর রহমতের দরজা তার বান্দাহর জন্য খোলা থাকে। তাই বিশ্বনবী (সা.) উম্মতের  উদ্দেশে বলেন, ‘শাবানের ১৫তম রাতে তোমরা জেগে থেকে আল্লাহর বন্দেগি কর এবং দিনের বেলায় রোজা রাখ’।

রাসূল (সা.) আরো বলেন- ‘লাইলাতুল বরাতে’ সূর্যাস্তের ক্ষণেই আল্লাহপাক প্রথম আকাশে নেমে এসে বান্দাদের উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘ক্ষমা প্রার্থনাকারী কেউ আছে কি? আমি ক্ষমা করব। রিজিক প্রার্থনাকারী কেউ আছে কি যাকে আমি রিজিক দেব? বিপদগ্রস্ত কেউ আছে কি যাকে আমি উদ্ধার করব?’ পবিত্র এ রাতের ফজিলত অসীম। তাই নবী (সা.) স্বয়ং এ রাতের অর্ধেক সময় নফল নামাজ ও বাকি অর্ধেক সেজদার মাধ্যমে অতিবাহিত করতেন। হাদিস শরিফে আছে- কোনো এক রাতে জিবরাইল (আ.) ফেরেস্তা নবী করিম (সা.)-কে বললেন-ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.)-আপনি উঠুন, নামাজ পড়ুন এবং আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করুন, কারণ এ রাত ১৫তম শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের জন্য একটি রহমতের দরজা উন্মুক্ত করেছেন, আপনি আপনার উম্মতদের জন্য দোয়া করুন। 

কিন্তু মাদকাসক্ত, নেশাখোর, মদ্যপায়ী, সুদখোর, জাদুকর, গণক, কৃপণ, পিতা-মাতার অবাধ্য ও দুঃখপ্রদানকারী সন্তান, হিংসা-বিদ্বেষকারী ও স্বামীর অবাধ্য স্ত্রীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন না, কারণ এদের জন্য আল্লাহর আজাব নির্ধারিত আছে। এদের দোয়া কবুল হবে না। 

শবেবরাতে আল্লাহর এবাদত করার নিয়তে গোসল করার মর্যাদা অতুলনীয়। এ বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি শবেবরাতের রাতে এবাদতের নিয়তে গোসল করে পবিত্র হবে, তার গোসলের প্রত্যেক ফোঁটা পানির বদলে সাত রাকাত নফল নামাজের সওয়াব লেখা হয়। মহানবী এ রাতে কবরস্থান জিয়ারত করতেন। 

‘জান্নাতুল বাক্কি’ নামক কবরস্থানে জিয়ারত কালে তিনি বিবি আয়েশা (রা.)-কে বলেন, আমার কাছে জিবরাইল (আ.) এসে বললেন যে আজ শাবানের ১৫তম রাত। এই রাতে আল্লাহতায়ালা ততজন গুনাহগারকে ক্ষমা করে দেবেন, যতগুলো লোম মেষের গায়ে আছে। মহাপুণ্যময় এই রজনীতে দয়ালু আল্লাহ রহমতের দরজা খুলে রাখেন, অথচ অনেকেই আনন্দের সঙ্গে শরিয়ত-বিরোধী আচার-অনুষ্ঠান করে সময় অতিবাহিত করে থাকেন। আসুন সবাই এ পবিত্র রাতটি শরিয়ত সম্মতভাবে এবাদত বন্দেগি করে জীবনকে ধন্য করি। 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট