Image description

দক্ষিণাঞ্চলে উপকূলের বেড়িবাঁধ না থাকলে যেমন জনভূমি এবং জনবসতি থাকত না, সাগর যদি মানুষের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ হতো, তবে সাগরের সম্পদ টিকিয়ে রাখা দুষ্কর হয়ে পড়ত, সুন্দরবনে যদি বাঘ না থাকত, তবে এ বনকে টিকিয়ে রাখা যেত না তেমনি সুন্দরবন যদি না থাকত তাহলে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরে উপকূলের কোনো চিহ্ন থাকত না। আজ সেই মায়ারূপী সুন্দরবন হারিয়ে যেতে বসেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ইতোমধ্যেই বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি লাভ করেছে। 

জনশ্রুতি রয়েছে ‘সুন্দরবন যদি না থাকত হয়তো সিডরে উপকূলের কোনো চিহ্নই থাকত না।’ যে বনটি চোখে আঙুল দিয়ে সেই চোখরূপী ভয়ঙ্কর সিডরকে বুঝিয়ে দিল আর উপকূল অঞ্চলকে রক্ষা করল আজ সেই সুন্দরবন নিজেই এখন ধ্বংসের পথে। সুন্দরবন আমার মায়ের মতন। মা যেমন সন্তানকে আগলে রাখে, তেমনি সুন্দরবন আমাদের আগলে রাখে। সুন্দরবন; আমার মা, আমার অহংকার। শিশুরা যেমন নিশ্চিন্তে মায়ের কোলে নিরাপদে থেকে খেলা করে, গড়াগড়ি খায় ঠিক তেমনি করেই বাঘেরা গর্জন করে, হরিণেরা এঁকে দেয় মায়াভরা চাহনি, সাদা বক তার সফেদ ডানা মেলে উড়ে যায় পানির আয়নার উপর দিয়ে, হরদম চলে বানরের নিবিড় উল্লাস, সবাই এখানে স্বাধীন, ঠিক মায়ের শাসনে যেমনটা স্বাধীন থাকে। 

এভাবে সুন্দরবন সিডরে উপকূলের মানুষকে মায়ের মতন আগলে রেখেছে। সুন্দরবন (মা) আমাদের অঢেলভাবে ভালোবেসেছে, এবার আমাদের ভালোবাসার পালা। একইসঙ্গে সুন্দরবন দেশের অর্থনীতি, প্রাণিবৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমানভাবে অবদান রাখছে। দেশের স্বার্থেই এ বনকে টিকিয়ে রাখা আমাদের জরুরি। যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় সুন্দরবন আমাদের রক্ষা করে? উত্তরে জবাব আসবে হ্যাঁ, যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় সুন্দরবন উপক‚লকে কতটুকু রক্ষা করে? উত্তরে একই জবাব আসবে হ্যাঁ। 

যদি প্রশ্ন করা হয় সুন্দরবন কি ধ্বংস হচ্ছে? উত্তরে আসবে হ্যাঁ। কিন্তু কারা ধ্বংস করছে এবং কি পন্থায় অথবা এর সংখ্যাই বা কত? এর উত্তর সঠিক আসবে না। অথচ দিন দিন উপক‚লের রক্ষা কবজ তথা দেশের রক্ষাকবজ সুন্দরবন আজ হারিয়ে যাচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। এর দায় কার, কে দায়ভার নিবে? অথচ অল্প কিছু মানুষের লোভ-লালসা আর অপকর্মের শিকার হচ্ছে বন নির্ভরশীল মানুষ ও গোটা বনের জীববৈচিত্র্য সুন্দরবনে। 

সেই সুন্দরবন ধ্বংসলীলায় মেতে উঠছে মানুষ। কখনো আগুন দিয়ে, কখনো গাছ কেটে, কখনো সুন্দরবনের খালে বিষ দিয়ে মাছ মারা, কখনো বনের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা ইত্যাদি। অথচ সুন্দরবন ধ্বংস হলে শুধু দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতি ভেঙে পড়বে না, উপক‚ল ধ্বংস হয়ে যাবে। সুন্দরবন ধ্বংসে যারা মেতে উঠছে তাদের সংখ্যা যেমন কম, এর প্রতিবাদে যারা সোচ্চার তাদের সংখ্যাও কম অথচ পরিবেশবাদীদের বলা হয়, পরিবেশবাদীরা নাকি উন্নয়নবিরোধী। আমরা মোটেও উন্নয়নবিরোধী নই। পরিবেশের উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নও চাই আমরা। সরকারকে আমরা জানাতে চাই সুন্দরবনের ক্ষতি করে কোনো ধরনের প্রকল্প স্থাপন করা চলবে না। 

সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনাটিই নতুন নয়। বনজীবী, সুন্দরবন অঞ্চলের আশপাশের স্থানীয় মানুষ, বন বিভাগ ও গণমাধ্যমসূত্র মিলিয়ে দেখা যায় গত ১৪ বছরে প্রায় ১৮ বার আগুন লেগেছে সুন্দরবনে। ‘সুন্দরবননিউজডটকম’ নামে একটি অনলাইনভিত্তিক নিউজপোর্টাল সরকারি ও বেসরকারি সূত্র দিয়ে জানিয়েছে, ১০ বছরে ১৬ বার আগুন লেগেছে সুন্দরবনে। ২০০২ সালের ২২ মার্চ শরণখোলা রেঞ্জের কটকা অভয়ারণ্যে আগুন লাগে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় প্রায় এক একর বন। ২০০৪ সনের ২৫ মার্চ আগুনে পুড়ে যায় চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলী ক্যাম্পের মাদ্রাসার ছিলা অঞ্চলের ৩ একর বন। 

২০০৪ সনের ২৭ ডিসেম্বর আড়–য়ারবেড় অঞ্চলে পুড়ে যায় ৯ শতক বন। ২০০৫ সনের ৮ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের কলমতেজী অঞ্চলে পুড়ে যায় আড়াই একর বন। একই সনের ১৩ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের তুলাতলার পুড়ে চার একর বন। এর পর ২০০৬ সন থেকে লাগাতার বন পুড়তেই থাকে। প্রথমত ১৯ মার্চ শরণখোলা রেঞ্জের তেরাবেকায় পুড়ে এক একর বন। একই সনের ১১ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া টহলফাঁড়ি অঞ্চলে পুড়ে ৫০ শতক বন। আবারো ১২ এপ্রিল কলমতেজী টহলফাঁড়ির খুটাবাড়িয়া এলাকায় পুড়ে দেড় একর। কলমতেজীতে এর আগের বছরই পুড়েছিল আড়াই একর বন। 

২০০৬ সনের পহেলা মে একই রেঞ্জের নাংলী ফাঁড়ির পচাকুড়ালিয়া এলাকায় পুড়ে ৫০ শতক বন এবং ৪ মে ধানসাগর স্টেশনসংলগ্ন এলাকায় পুড়ে আড়াই একর বন। ২০০৭ সনেও তিনবার আগুন লাগার ঘটনা জানা যায়। এই সনের ১৫ জানুয়ারি শরণখোলার ডুমুরিয়া ক্যাম্প এলাকায় ৫ একর, ১৯ মাচং চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলী এলাকায় ২ একর ও একই অঞ্চলে ২৮ মার্চ পুড়ে যায় ৮ একর বন। ২০০৮ এবং ২০০৯ সনে আগুন লাগার ঘটনা জানা যায় নাই। আবারো ২০১০ সনের ২০ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের গুলিশাখালী এলাকায় পুড়ে যায় ৫ একর বন। ২০১১ সনেও তিনবার আগুন লাগে। 

১ মার্চ নাংলী অঞ্চলের ২৫নং কম্পার্টমেন্টে পুড়ে প্রায় ২ একর এবং একই সনের ৮ মার্চ আড়–য়ারবেড় অঞ্চলে পুড়ে যায় ৩ একর বন। ২০১৪ সনে আবারও ২০০৪ সনের মত কালরাত্রি নেমে আসে। ভোলা নদী থেকে প্রায় দুই কি.মি. ভেতরে চাঁদপাই রেঞ্জের গুলিশাখালীর পয়ষট্টিছিলা অঞ্চলে ২৫ মার্চ পুড়ে যায় ১০ একর বন। ২০০৪ থেকে ২০১৬ সনের ২৮ মার্চ পর্যন্ত দেখা যায় সুন্দরবনের প্রায় ৬০ একর বনাঞ্চল আগুনে পুড়েছে বা ঝলসে দেয়া হয়েছে। সবশেষ ২০১৭ সালের ২৬ মে সুন্দরবনের নাংলী ক্যাম্পের মাদ্রাসার ছিলা এলাকায় আগুনে প্রায় ৪ একর বনভ‚মি পুড়ে যায়। 

২০২৪ সালের একটি পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী গত ২২ বছরে সুন্দরবনের ৩২ বার আগুন লেগেছে। পুড়ে ছাই হয়েছে শতাধিক একর বনভ‚মি। কঠোর মনিটরিংয়ের অভাবে সুন্দরবনে বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে এবং বনভ‚মি পুড়ছে। বারবার বনে আগুন লাগলেও তা নেভানোর সক্ষমতা দেখা যাচ্ছে না। ঘনবসতির চাপে প্রাণবৈচিত্র্য বিলুপ্ত হওয়ার সম্মুখীন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক ধরনের ‘লাইফ সাপোর্ট’ দিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবন। এটি বনজ, মৎস্য ও পশুসম্পদের একটি বিশাল আধার। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা এটিকে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছে। অথচ আমরা সুন্দরবনকে করছি অবহেলা।

বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলকে সংরক্ষণ করার কোনো বিশেষ পরিকল্পনা না থাকলেও অবহেলা অবিচার করতে আমাদের কুণ্ঠা হচ্ছে না। বিস্ময়কর হলো, ভারতের সাথে যৌথ উদ্যোগে সেখানে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। এ ক্ষেত্রে পরিবেশবিদদের পুনঃপুন সতর্কতাকেও উপেক্ষা করা হয়েছে। সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ যে যেভাবে পারছে লুণ্ঠন করছে। এমনকি এটি এখন ব্যবহার হচ্ছে নৌযান চলাচলের রুট হিসেবে। 

সম্প্রতি সুন্দরবনের অভ্যন্তরে জাহাজডুবির ঘটনায় ৩ লাখ ৫০ হাজার লিটারের বেশি ফার্নেস অয়েল ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে সমৃদ্ধ এ বনকে বিপন্নের মুখোমুখি করেছে। সুন্দরবনের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ পরিবেশগত বিপর্যয়ে প্রাণিবৈচিত্র্যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কা করা হচ্ছে। জানা যায়, তেল ছড়িয়ে পড়া এলাকাটি সরকার ঘোষিত ডলফিনের অভয়ারণ্য। তেলের আস্তরণ বনের শ্বাসমূলীয় গাছপালার শ্বাস-প্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত করবে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

সুন্দরবন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য এবং জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। জাতিসংঘের ওই দুই সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী সুন্দরবনের ভেতর এ এলাকা দিয়ে নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। কিন্তু ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে নৌপরিবহন অধিদপ্তর বন আইন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, জাতিসংঘের কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি (সিবিডি), ইউনেস্কোর বিশ্ব-ঐতিহ্য কমিশনের নিয়ম লঙ্ঘন করে বনের ভেতর দিয়ে নৌপথ চালু করে। 

এমনকি, সহযোগী একটি পত্রিকার মতে, ১ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে নৌপথটি বন্ধের জন্য নির্দেশ দিলেও বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়নি। বরং আমরা লক্ষ্য করেছি, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বনবিনাশী বিভিন্ন তৎপরতা থেমে নেই। এ নিয়ে সরকারের উদ্যোগগুলো এরই মধ্যে নেতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সুন্দরবন আমাদের মায়ের মতন। মা যেমন সন্তানকে আগলে রাখে, তেমনি সুন্দরবন আমাদের আগলে রাখে। একইসঙ্গে সুন্দরবন দেশের অর্থনীতি, প্রাণিবৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতিরোধ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমানভাবে অবদান রাখছে। 

আমাদের ও দেশের স্বার্থেই এ বনকে টিকিয়ে রাখা আমাদের জরুরি। তাই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে হোক, আর যে কোনো উপায়ে হোক সুন্দরবনের ক্ষতি কাটিয়ে এটিকে রক্ষা করতে হবে। এ মুহূর্তে কার দোষ, কার গুণ খোঁজার আগে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা জরুরি। আগে সুন্দরবনকে বাঁচাতে হবে। উন্নয়নের নামে লোভের আগ্রাসন থেকে সুন্দরবন বাঁচার লড়াই করছে, সুন্দরবন মরলে আমাদেরও অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। বাঁচতে গেলে আমাদের বিশুদ্ধ পানি লাগবে, খাদ্য লাগবে, শ্বাস নেয়ার জন্য বিশুদ্ধ বাতাস লাগবে, আমাদের অস্তিত্বের জন্য বন লাগবে, জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুসংস্থান লাগবে। তাই আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সুন্দরবনকে বাঁচাই, নিজেরা বাঁচি। মাকে বাঁচাই।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গবেষক