Image description

বিশ্বে মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য যত আন্দোলন হয়েছে তার মধ্যে ভারতবর্ষের ইতিহাসই উল্লেখযোগ্য। ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শহীদের ইতিহাস এই উপমহাদেশে দীর্ঘ। বিশ্বের আর কোথাও মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য জীবন দানের ইতিহাস নেই। বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য আমাদের দেশের ইতিহাস কারও অজানা নয়। কিন্তু এক নারী শহীদের অজানা কথা আমরা ভুলতে বসেছি। তার কথা প্রায় বিস্মৃত হয়ে গেছে। কমলা ভট্টাচার্য্য বিশ্বের প্রথম নারী ভাষা শহীদ। 

বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৬১ সালের ১৬ মে আসামের শিলচর স্টেশনে বিক্ষোভকারীদের উপর আধা সামরিক বাহিনীর গুলিতে যে ১১ জন শহীদ হয়েছিলেন, কমলা ভট্টাচার্য্য ছিলেন তাদেরই একজন। কমলা ভট্টাচার্য্যরে জন্ম অবিভক্ত বাংলার সিলেটে ১৯৪৫ সালে। পিতা রামরমন ভট্টাচার্য্য ও মাতা সুপ্রবাসিনী দেবী। সাতভাই বোনের মধ্যে কমলা পঞ্চম আর বোনদের মধ্যে তৃতীয়। মাত্র পাঁচ বছর বয়সে উদ্বাস্তু হয়ে সিলেটের শিলচরে পা রেখে ছিল কমলা। 

শিক্ষাজীবন শুরু হয় ‘ছোটে লাল শেঠ ইনস্টিটিউটে’। অত্যন্ত গরিব পরিবারে বড় হওয়া তার। বই কেনার সামর্থ্য পর্যন্ত ছিল না তাদের। অন্যের কাছ থেকে পুরনো বই চেয়ে শিক্ষাজীবন চলতো তার। কমলা যখন দশম শ্রেণির ছাত্রী, বরাক উপত্যকা তখন উত্তাল ভাষার সংগ্রামে। শিশুকাল থেকেই কমলা অত্যন্ত জেদী এবং লড়াকু স্বভাবের ছিল। তাই সরকারের ভাষানীতির বিরুদ্ধে সেও হয়ে ওঠে সোচ্চার। ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে শিলচরের কাছাড়ে তখন গঠিত হয়েছে ‘কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদ’। 

সেখানেই নেতাদের বক্তৃতা শুনে ভাষা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয় কমলা। সামনেই তখন তার মাধ্যমিক পরীক্ষা। ১৯৬১ সালের ১৬ এপ্রিল আন্দোলনকারীরা পালন করে ‘সংকল্প দিবস’। সত্যাগ্রহী আন্দোলনকারীরা ১৯ এপ্রিল থেকে পদযাত্রা শুরু করেন এবং ২ মে শিলচরে পৌঁছান। শপথ অনুযায়ী ১৩ এপ্রিলের মধ্যে ভাষা বিল বাতিল না হলে ১৯ মে বরাক উপত্যকায় সর্বাত্মক হরতাল। ১৮ মে ছিল মাধ্যমিক পরীক্ষার শেষদিন। পরীক্ষার পরদিন কমলা যোগ দেন হরতাল কর্মসূচিতে। একে তো তারা দেশ হারানো মানুষ। অন্যদিকে বিপন্ন তাদের মাতৃভাষা। এবোধ কমলাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। সুপ্রবাসিনী দেবী মেয়ের এ মনোভাব বুঝতে পেরেছিলেন। 

তবু তিনি বাধা দেননি মেয়েকে। মেয়ে অজানা বিপদের আশঙ্কায় নীরবে চোখের পানি ফেলেছেন। মেজ বোন হরতালে যেতে নিষেধ করেছিল কিন্তু কমলা তা আমলেই নেয়নি। ১৯৬১ সালের ১৯ মে সকালে মেজ বোন প্রতিভার স্কুলে যাবার জন্য রাখা শাড়ি আর ব্লাউজ পরেই কমলা বের হয়ে যায়। যাবার আগে মায়ের কাছ থেকে একটুকরো কাপড় চেয়ে নেন কাঁদানে গ্যাস থেকে রক্ষা পাবার জন্য। খাবার মতো ঘরে কিছু না থাকায় বাসি মুখেই বেরিয়ে পড়ে সে।

সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নেত্রী জ্যোৎস্না চন্দের ডাকে ২০-২২ জনের নারীদলে যোগ দেন কমলা। উদ্দেশ্য শিলচর রেল স্টেশন। মায়ের মনে ছিল অস্বস্তি। তাই দুপুরে ছোট ভাই বকুল বড় বোনের ছেলে বাপ্পাকে সাথে নিয়ে চলে আসেন শিলচর স্টেশনে। কিন্তু কমলা অনড়। মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। সেই ছিল মায়ের সাথে শেষ দেখা। এ দিকে আন্দোলনের তীব্রতায় হতচকিত রাজ্য সরকার, আসাম রাইফেল বাহিনীকে পাঠায় রেলস্টেশনে। আন্দোলনরত নেতাদের ধরে ট্রাকে তুলে নিতে উদ্ধত হলে জনতা ট্রাক অবরোধ করে। সবার মুখে তখন শ্লোগান ‘বাংলাভাষা জিন্দাবাদ’ মাতৃভাষা জিন্দাবাদ’। 

এ সময় শুরু হয় আন্দোলনকারীদের উপর লাঠিচার্জ। ২.৪৫ মিনিটের সময় পুলিশ বিনা প্ররোচনায় ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালায়। এতে ১১ জন মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্যে একজন ছিল ১৬ বছরের কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য্য। একটি গুলি তার চোখ দিয়ে ঢুকে মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়।

বাড়ি থেকে আসার সময় কমলা তার ছোট বোন মঙ্গলকে সাথে করে এনেছিল কোন এক কাজের উপলক্ষে। তাকে আবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবার কথা ছিল। কিন্তু মঙ্গলা স্টেশনে এসে বোনকে একা ছেড়ে যেতে চায়নি। পুলিশের গুলিতে কমলা লুটিয়ে পড়লে মঙ্গলা বোনকে জড়িয়ে ধরে শুধু চিৎকার করে কেঁদেছিল। মঙ্গলাও গুলিতে আহত হয়েছিল। কিন্তু হাসপাতালে গিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেও চোখের সামনে বোনের মৃত্যু তাকে চিরদিনের জন্যে অপ্রকৃতিস্থ করে ফেলে।

মাধ্যমিক পাস করে চাকরিতে যোগ দিয়ে পরিবারকে সহযোগিতা করার আশা ছিল কমলার। মাধ্যমিকে তিনি পাস করেছিলেন ঠিকই। কিন্তু চাকরি আর করা হয়নি। দাঁড়ানো হয়নি পরিবারের পাশে। ১৯ মে সৃষ্টি হয় এক রক্তাক্ত ইতিহাস। কমলার আত্মদান বৃথা যায়নি। এ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকার ১৯৬১ সালে ‘সরকারি ভাষা’ আইন সংশোধন করে বাংলাকে অবিভক্ত কাছাড় জেলার সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। কমলাসহ ১১ জন শহীদের আবক্ষ মূর্তিসহ একটি ব্রোঞ্জ ফলক রয়েছে শিলচর স্টেশনের বেদির উপর। শিলচর স্টেশনকে ভাষাশহীদ স্টেশন হিসাবে নামকরণ করা হয়েছে। 

২০১১ সালে ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তিতে কমলার স্কুল ‘ছোটে লাল শেঠ ইনস্টিটিউটে’ কমলার একটি আবক্ষ ব্রোঞ্জ মূর্তি স্থাপন করা হয়। শিলচরের পাবলিক স্কুলের গা ঘেঁষে চলে যাওয়া সড়কটির নামকরণ করা হয় কমলা ভট্টাচার্য্য সড়ক। এ রাস্তার পাশেই ভাড়া থাকত কমলার পরিবার।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট