
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান মন্তব্য করেছেন যে, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান জোর দাবি তাদের জন্য একটি ‘ঐতিহাসিক ভুল’ হতে চলেছে। তিনি মনে করেন, এই দাবি যদি রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল বা নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যাহত করার কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তবে তা আত্মঘাতী হবে এবং দেশের পাশাপাশি জামায়াতের নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
নিজের ইউটিউব চ্যানেল ‘জাহেদস টেইক’-এ এসে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশনে হওয়া উচিত বলে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি ইসলামী দলের জোর দাবির প্রসঙ্গে কথা বলেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এই দাবির পেছনে আসলে কী রাজনৈতিক উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে।
জাহেদ উর রহমান বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি (পিআর) নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক তখন মনে করেছিলেন, এই পদ্ধতি চালু হলে তা শুধু সংসদের উচ্চকক্ষে (আপার হাউস) সীমিত থাকা উচিত। কারণ, এখন যে এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদ (লোয়ার হাউস) আছে, সেখানে পিআর ব্যবস্থা চালু হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। সরকার গঠন করা কঠিন হবে এবং জোট রাজনীতির কারণে নানা চাপ ও সমস্যা দেখা দিতে পারে।
তিনি আরও বলেন, জামায়াত এখন যেভাবে সংখ্যানুপাতিক ব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে তারা এটিকে একটি রাজনৈতিক চাপের কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছে। বিএনপি বা অন্য শক্তিগুলোর ওপর চাপ তৈরি করে হয়তো তারা কিছু সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে, যেমন অন্তত উচ্চকক্ষে পিআর ব্যবস্থা মেনে নেওয়ার প্রস্তাব। যদি এটি শুধুই একটি রাজনৈতিক চাপ হয়, তাহলে তা কিছুটা গ্রহণযোগ্য। কিন্তু যদি উদ্দেশ্য হয় নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বিলম্বিত বা বাধাগ্রস্ত করা, তাহলে বলা যেতে পারে জামায়াত আবারও একটি বড় রাজনৈতিক ভুলের পথে হাঁটছে।
জাহেদ উর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে জামায়াতের জনমতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন: ১৯৪৬-৪৭ সালে গণভোটের সময় ভারতের অখন্ডতার পক্ষে অবস্থান; ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা; ১৯৮৬ সালে সামরিক সরকারের নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনের সময়েও তাদের অবস্থান ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এখন আবার তারা এমন একটি দাবি করছে, যা সরকারের স্থিতিশীলতা বিপন্ন করতে পারে।
তিনি বর্তমান বাংলাদেশের ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ পদ্ধতির কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করে বলেন, এটি স্থিতিশীল সরকার গঠনের জন্য কার্যকর। প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন চালু হলে এমন হতে পারে যে, একটি দল ৪০% ভোট পেয়েও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না এবং সরকার গঠনে জোটসঙ্গীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়বে। প্রতিনিয়ত মন্ত্রিত্ব, সুবিধা ভাগাভাগি, সমর্থন প্রত্যাহার—এই দোদুল্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হবে, যা বাংলাদেশের জন্য উপযোগী নয়।
তিনি উপসংহারে বলেন, জামায়াত জানে যে সরাসরি নির্বাচনে তারা বেশি আসন হয়তো পাবে না। কিন্তু পিআর পদ্ধতি হলে ১০% ভোট পেলেই তারা ৩০টি আসন পেতে পারে। তাই তারা এই ব্যবস্থার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে, যা রাষ্ট্রীয় স্বার্থ নয়, দলীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য। এই কৌশলের পেছনে তারা হয়তো ধারণা করছে, নির্বাচন হলে বিএনপি সরকার গঠন করবে এবং সেই সরকারের একচ্ছত্র প্রভাব তাদের বর্তমান প্রশাসনিক সুবিধা কেড়ে নেবে। বর্তমানে জামায়াতের সরকারে বা প্রশাসনে যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে, যা তারা অতীতে কখনোই উপভোগ করেনি। তাই তারা হয়তো মনে করছে, নির্বাচন ভণ্ডুল করতে পারলে এই প্রভাব আরও দীর্ঘস্থায়ী করা যাবে।
Comments