Image description

আমাদের জীবনে হঠাৎ ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত ক্ষতি, অসুস্থতা বা সাফল্যের ভাটা দেখে অনেকেই হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবেন, "কারোর বুঝি বদ নজর লেগেছে!" ইসলামি বিশ্বাস এবং লোক-ঐতিহ্যে 'বদ নজর' বা 'ঈভিল আই' একটি বহুল স্বীকৃত বিষয়। এটি এমন এক দৃষ্টি, যা ঈর্ষাপরায়ণ বা বিদ্বেষপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি, কখনও কখনও অনিচ্ছাকৃত প্রশংসার মাধ্যমেও অপরের ক্ষতিসাধন করতে পারে। এই অদৃশ্য অশুভ প্রভাব থেকে আত্মরক্ষার জন্য ইসলাম আমাদের এক শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়েছে – তা হলো আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা ও দোয়া। 

বদ নজর কী ও ইসলাম কেন তা স্বীকার করে?
বদ নজর হলো অন্যের প্রতি ঈর্ষাপূর্ণ বা অত্যন্ত মুগ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপের ফলে সৃষ্ট এক ধরনের অশুভ প্রভাব, যা লক্ষ্যবস্তুর ক্ষতি করে। এটি কারো স্বাস্থ্য, সম্পদ, সৌন্দর্য বা সুখের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
নবী মুহাম্মদ (সা.) একাধিক হাদিসে বদ নজরের বাস্তবতা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন,"বদ নজর সত্য। যদি কোনো কিছু তাকদিরের (আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত ভাগ্য) চেয়ে এগিয়ে যেত, তবে তা হতো বদ নজর।" (সহীহ মুসলিম)
তাই, এই অশুভ শক্তি থেকে বাঁচার জন্য শুধুমাত্র সতর্কতা নয়, আল্লাহর উপর ভরসা রেখে তাঁর শেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করাই মুমিনের কর্তব্য।
বদ নজর থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধান কোরআনিক দোয়া (মু'আওয়িযাতাইন)
বদ নজর এবং সকল প্রকার অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য কোরআনে দুটি বিশেষ সুরার উল্লেখ রয়েছে, যা নিয়মিত পাঠ করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ সুরক্ষা পাওয়া যায়। এগুলোকে একত্রে ‘মু’আওয়িযাতাইন’ বা আশ্রয় প্রার্থনার সূরা বলা হয়।

সূরা আল-ফালাক 
এটি সমস্ত সৃষ্টির অনিষ্ট, রাতের অন্ধকারের অনিষ্ট, নারীদের জাদুকরীর অনিষ্ট এবং হিংসুকের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার জন্য কার্যকর। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা এই সূরা পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম।

সূরা আন-নাস
এই সূরাটি জীন ও মানুষের মধ্য থেকে সৃষ্ট কুমন্ত্রণা দানকারীর অনিষ্ট থেকে এবং শয়তানের প্ররোচনা থেকে রক্ষার জন্য বিশেষভাবে নির্দেশিত।
আমল: ফজর ও মাগরিবের নামাজের পর এবং রাতে ঘুমানোর আগে এই দুটি সূরা এবং সূরা ইখলাস (সূরা তওহিদ) পাঠ করে হাতের তালুতে ফুঁ দিয়ে সারা শরীরে বুলিয়ে নেওয়া সুন্নাহ সম্মত আমল।

আয়াতুল কুরসি
কোরআনের সর্বশ্রেষ্ঠ এই আয়াতটি সকল প্রকার বিপদাপদ ও শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করে। রাতে ঘুমানোর আগে এটি পাঠ করলে সকাল পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন ফেরেশতা তাকে পাহারা দেন।

হাদিস থেকে প্রমাণিত বিশেষ সুরক্ষার দোয়া
বদ নজর থেকে সুরক্ষার জন্য নবী করিম (সা.) তাঁর নিজের পরিবার ও সাহাবীদের কিছু বিশেষ দোয়া শিখিয়েছেন:

সাধারণ সুরক্ষার জন্য দোয়া
সকাল-সন্ধ্যা এই দোয়াটি তিনবার পাঠ করার বিশেষ ফজিলত রয়েছে:
দোয়া (বাংলা উচ্চারণ): বিসমিল্লাহিল লাজি লা ইয়া দুররু মাআসমিহি শাইউন ফিল আরদি ওয়ালা ফিস সামা-ই, ওয়া হুওয়াস সামি'উল আলিম।
অর্থ: আল্লাহর নামে, যাঁর নামের বরকতে আসমান ও জমিনের কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারে না। তিনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী।

যখন কারো সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবেন
অনেক সময় অনিচ্ছাকৃত মুগ্ধতার দৃষ্টি থেকেও বদ নজর লাগতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক এই দোয়াটি পড়া উচিত, যেন যার দিকে তাকানো হয়েছে তার কোনো ক্ষতি না হয়:
দোয়া: মাশা আল্লাহ, লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ।
অর্থ: আল্লাহ যা চেয়েছেন, তা-ই হয়েছে। আল্লাহর সাহায্য ছাড়া কোনো শক্তি নেই।

অসুস্থ বা আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য বিশেষ দোয়া
যদি কেউ বদ নজরের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন বা কোনো অনিষ্টের শিকার হন, তবে নিম্নোক্ত দোয়াটি পড়ে তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে আরোগ্য চাইতে হবে:
দোয়া: আ‘ঊযু বিকালিমা-তিল্লাহিত তা-ম্মাতি মিন কুল্লি শাইত্বা-নিন ওয়া হা-ম্মাহ, ওয়া মিন কুল্লি ‘আইনিন লা-ম্মাহ।
অর্থ: আমি আল্লাহর পরিপূর্ণ বাক্যসমূহের মাধ্যমে প্রত্যেক শয়তান, বিষাক্ত প্রাণী এবং অনিষ্টকারী দৃষ্টির কুপ্রভাব থেকে আশ্রয় চাচ্ছি।

প্রতিরোধের ব্যবহারিক আমল ও সতর্কতা
বদ নজর থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকতে দৈনন্দিন জীবনে কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন:
নিয়মিত জিকির ও দোয়া: সকাল-সন্ধ্যা উপরোক্ত দোয়াগুলো এবং অন্যান্য মাসনূন দোয়াগুলো (সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত) নিয়মিত পাঠ করা।

গোপনীয়তা রক্ষা: আপনার সাফল্য, সম্পদ বা সুখের বিষয়টি মাত্রাতিরিক্ত প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকুন। নবী (সা.) বলেছেন, "তোমাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য গোপনীয়তার আশ্রয় নাও।"

বিসমিল্লাহ: কোনো কাজ শুরু করার আগে বা কোনো সুন্দর কিছু দেখার সময় 'বিসমিল্লাহ' বলা এবং আল্লাহর নাম নেওয়া।
শিশুদের সুরক্ষা: ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে নিয়মিত মু'আওয়িযাতাইন পড়ে ফুঁ দেওয়া এবং অযাচিত প্রদর্শন থেকে বিরত থাকা।
তাওয়াক্কুল (ভরসা): মনে রাখতে হবে, সুরক্ষা কেবল আল্লাহর কাছ থেকেই আসে। দোয়া পাঠের পাশাপাশি আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা রাখা আবশ্যক।

বদ নজর একটি বাস্তবতা হলেও, তা আল্লাহর অনুমতিক্রমে ছাড়া কোনো ক্ষতি করতে পারে না। একজন মুমিনের জন্য এই পরিস্থিতিতে আতঙ্কিত না হয়ে, বরং কোরআন ও সুন্নাহ নির্দেশিত দোয়াসমূহকে তাঁর সুরক্ষার জন্য শক্তিশালী 'ঈমানী ঢাল' হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। নিয়মিত ইবাদত, জিকির এবং পূর্ণ ভরসার মাধ্যমে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করাই হলো সকল প্রকার অনিষ্ট থেকে বেঁচে থাকার প্রধান উপায়।