
বিশ্ব ইতিহাসে বহু প্রভাবশালী নেতা জনগণের ক্ষোভ, বিপ্লব বা সামরিক অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা হারিয়ে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ গোপনে আত্মগোপনে গেছেন, আবার কেউ কারাগার বা মৃত্যুদণ্ড এড়াতে পালিয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে মাদাগাস্কারের প্রেসিডেন্ট আন্দ্রে রাজোয়েলিনা ও বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন এমন ঘটনার উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এই প্রতিবেদনে বিশ্বের কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার এমন করুণ পরিণতির কাহিনী তুলে ধরা হলো।
বাশার আল-আসাদ, সিরিয়া
২০২৪ সালে সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ বিদ্রোহী বাহিনীর দামেস্কের দিকে অগ্রসর হওয়ার মুখে রাশিয়ায় পালিয়ে যান। এর মাধ্যমে তার পরিবারের ৫১ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধে রাশিয়া ও ইরানের সমর্থন থাকলেও বিদ্রোহীদের কাছে তিনি পরাজিত হন। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাকে, তার পরিবার ও ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের আশ্রয় দেন এবং প্রত্যর্পণের দাবি প্রত্যাখ্যান করেন।
শেখ হাসিনা, বাংলাদেশ
২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের দীর্ঘতম মেয়াদে দায়িত্ব পালনকারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নিরাপত্তা বাহিনীর দমনপীড়নে কমপক্ষে ১,৪০০ জন নিহত হন। হাসিনা বর্তমানে ভারতে নির্বাসনে রয়েছেন। তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন এবং ২০০৮ সালে ফিরে এসে টানা ১৬ বছর শাসন করেন। তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রনেতা, ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন।
কেপি শর্মা ওলি, নেপাল
নেপালের বর্ষীয়ান প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি ২০২৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর জেন জি নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের প্রতিবাদে তরুণদের আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে তার সরকার পতনের মুখে পড়ে। ফলে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন।
গোটাবাইয়া রাজাপাকসে, শ্রীলঙ্কা
২০২২ সালের জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মালদ্বীপে পালিয়ে যান। দেশটি খাদ্য ও জ্বালানির জন্য নগদ অর্থহীন হয়ে পড়ে এবং ঋণখেলাপি অবস্থায় পতিত হয়। জনগণের ক্ষোভের মুখে রাজাপাকসে পরিবারের রাজনৈতিক আধিপত্য ভেঙে পড়ে। গোটাবাইয়া, তার ভাই মাহিন্দ রাজাপাকসে এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ, ইউক্রেন
২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ গণবিক্ষোভের মুখে কিয়েভ ছেড়ে রাশিয়ায় পালিয়ে যান। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে রাশিয়ার কাছ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণ নেয়ার সিদ্ধান্তে বিক্ষোভের সূত্রপাত হয়। সমঝোতার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তিনি গোপনে দেশ ত্যাগ করেন। পরে সংসদ তাকে অভিশংসিত করে এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। রাশিয়ান বাহিনীর সহায়তায় তিনি ক্রাইমিয়া হয়ে রাশিয়ায় পৌঁছান।
মুয়াম্মার গাদ্দাফি, লিবিয়া
২০১১ সালে লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি আরব বসন্তের প্রভাবে বিদ্রোহীদের হাতে ৪০ বছরের শাসন হারান। ত্রিপোলি দখল হলে তিনি সির্তে-তে লুকিয়ে পড়েন। ২০ অক্টোবর, ২০১১-তে পালানোর চেষ্টাকালে ন্যাটোর বিমান হামলায় তার কাফেলা আক্রান্ত হয়। বিদ্রোহীরা তাকে একটি নর্দমার পাইপে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় আটক করে হত্যা করে। তার মৃতদেহ প্রকাশ্যে প্রদর্শনের পর মরুভূমিতে গোপনে দাফন করা হয়।
মার্ক রাভালোমানানা, মাদাগাস্কার
মাদাগাস্কারের ষষ্ঠ প্রেসিডেন্ট মার্ক রাভালোমানানা ২০০৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। তৎকালীন মেয়র আন্দ্রে রাজোয়েলিনার নেতৃত্বে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় পালিয়ে যান। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই ঘটনাকে অভ্যুত্থান হিসেবে ঘোষণা করে এবং অর্থনৈতিক সহায়তা স্থগিত করে। নির্বাসনের পাঁচ বছর পর দেশে ফিরে তিনি গৃহবন্দি হন, তবে পরবর্তীতে মুক্তি পান।
জ্যাঁ-বারট্রান্ড আরিস্টাইড, হাইতি
হাইতির প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জ্যাঁ-বারট্রান্ড আরিস্টাইড দুইবার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। ১৯৯১ সালে ছয় মাস দায়িত্ব পালনের পর ভেনেজুয়েলায় পালান। ১৯৯৪ সালে মার্কিন সহায়তায় পুনর্বহাল হলেও ২০০৪ সালে জনবিক্ষোভে পদত্যাগ করেন। তিনি মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে পালিয়ে যান এবং পরে দক্ষিণ আফ্রিকায় আশ্রয় নেন। ২০১১ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
গণ-অভ্যুত্থান ও বিপ্লবের মাধ্যমে জনগণের ক্ষোভ কীভাবে প্রভাবশালী নেতাদের পতন ঘটায়, তা এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমে স্পষ্ট। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অর্থনৈতিক সংকট এবং সামাজিক অসন্তোষ এসব আন্দোলনের মূল কারণ। বাংলাদেশ থেকে মাদাগাস্কার, সিরিয়া থেকে শ্রীলঙ্কা—এই ঘটনাগুলো বিশ্ব রাজনীতিতে জনগণের ক্ষমতার প্রমাণ বহন করে।
Comments