Image description

সীমান্ত, নিছকই দুটি দেশের মধ্যে আঁকা একটি কাল্পনিক রেখা নয়; এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়, তার সার্বভৌমত্বের অভেদ্য প্রাচীর এবং অর্থনীতির প্রাণভোমরা। যখন এই দুর্ভেদ্য প্রাচীর অরক্ষিত হয়ে পড়ে, তখন তার ফাটল গলে প্রবেশ করে এক সর্বনাশা ব্যাধি-চোরাচালান। এটি কেবল কিছু নিষিদ্ধ পণ্যের আদান-প্রদান নয়, বরং এক সুসংগঠিত অপরাধচক্রের বিষাক্ত জাল, যা ধীরে ধীরে একটি দেশের মেরুদণ্ডকে পঙ্গু করে দেয়। চোরাচালান কেবল অর্থনৈতিক কাঠামোকেই দুর্বল করে না, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে হুমকিতে ফেলে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে। জাতিকে ঠেলে দেয় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। 

গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন যখন দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে কিছুটা ঢিলেঢালা করে তোলে, সেই সুযোগেই চোরাকারবারিরা যেন নতুন জীবন ফিরে পায়। ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো হয়ে ওঠে তাদের অভয়ারণ্য। সীমান্তের উভয় পাড়েই গড়ে ওঠে শক্তিশালী সিন্ডিকেট, যারা অস্ত্রের ঝনঝনানি, মাদকের বিস্তার আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অবৈধ প্রবাহে মাতিয়ে তোলে গোটা এলাকা। ওপার থেকে আসা অস্ত্রের চালান, মাদকের প্রলয়ঙ্করী স্রোত আর চোরাই পণ্যের স্তূপ এদেশের কিছু অসাধু চক্রের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে দেশের আনাচে-কানাচে, যা কেবল অর্থনীতির ভিত্তিমূলকেই নাড়িয়ে দেয় না, বরং দেশের সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেও করে তোলে অস্থিতিশীল।

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য চোরাচালান এক মরণব্যাধি। এর বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী যে তা দেশের অগ্রগতির চাকাকে অচল করে দেয়। চোরাচালানের কারণে সরকার হারায় বিপুল পরিমাণ রাজস্ব, যা দিয়ে দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা অবকাঠামো খাতে অনায়াসে বিনিয়োগ করা যেত। অবৈধ পণ্যের অবাধ প্রবাহ দেশীয় শিল্পকে গলা টিপে হত্যা করে। সন্তা চোরাচালানকৃত পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পেরে স্থানীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো ধুকে ধুকে মরে যায়, কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যায়, আর হাজার হাজার শ্রমিক হারায় তাদের জীবিকা। তবে চোরাচালানের প্রভাব কেবল অর্থনীতির গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়, এর সামাজিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত পরিণতি আরও ভয়াবহ। চোরাচালানের মাধ্যমে আসে মাদক, যা যুব সমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়, তাদের ভবিষ্যৎকে করে অন্ধকারাচ্ছন্ন। মাদকের করাল গ্রাসে পতিত হয়ে হাজারো তরুণ-তরুণী তাদের জীবনকে বিনষ্ট করছে, যা তাদের পরিবার ও সমাজের জন্য বয়ে আনছে অবর্ণনীয় দুঃখ আর বোঝা। অস্ত্রের অবাধ প্রবেশ অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে উস্কে দেয়, যা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে করে তোলে বিপন্ন। এই বিষাক্ত ব্যাধির বিরুদ্ধে লড়াই মোটেই সহজ নয়, কারণ এর পেছনে রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট এবং আন্তর্জাতিক অপরাধী চক্র। তারা এতটাই সুসংগঠিত যে তাদের রয়েছে এক বিশাল নেটওয়ার্ক। স্থানীয় কিছু অসাধু ব্যক্তির সহায়তায় তারা তাদের কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চালিয়ে যায়। এমনকি কখনো কখনো সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যরাও এই চক্রের প্রলোভনের শিকার হন, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। তাই, চোরাচালান দমনের জন্য একটি বহুমুখী এবং সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করা জরুরি। 

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের সীমান্ত ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজাতে হবে, একে আরও শক্তিশালী ও আধুনিক করতে হবে। ড্রোনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, নাইট ভিশন ক্যামেরার অতন্দ্র প্রহরা এবং সেন্সরের সূক্ষ্ম সংকেত ব্যবহার করে চোরাচালানকারীদের প্রতিটি গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। একই সঙ্গে, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য। তাদের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণ, আধুনিক সরঞ্জাম এবং পর্যাপ্ত জনবল নিশ্চিত করতে হবে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত, যাতে তারা চোরাচালানকারীদের নিত্যনতুন কৌশল সম্পর্কে অবগত থাকতে পারে এবং সে অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় আমাদের সীমান্ত হয়ে উঠুক এক অভেদ্য দুর্গ। চোরাচালান দমনের জন্য বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে নিবিড় সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। সীমান্তরক্ষী বাহিনী, পুলিশ, শুল্ক বিভাগ, কোস্ট গার্ড এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা আবশ্যক। যারা এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ এই ধরনের অপরাধ করার সাহস না পায়। আইনের ফাঁকফোকর বন্ধ করতে হবে এবং বিচার প্রক্রিয়ায় গতি আনতে হবে। একই সঙ্গে, চোরাচালানের মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ অর্থ বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করতে হবে, যাতে অপরাধীরা তাদের অবৈধ সম্পদের সুবিধা নিতে না পারে। জনসচেতনতা বৃদ্ধি এই লড়াইয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। সাধারণ মানুষকে চোরাচালানের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবহিত করতে হবে, তাদের বোঝাতে হবে যে চোরাচালানকৃত পণ্য কেনা মানে নিজের দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করা। তাদের উৎসাহিত করতে হবে, যাতে চোরাচালান সংক্রান্ত কোনো তথ্য পেলে তারা দ্রুত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানায়। বিশেষ করে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে, যাতে তারা চোরাচালানকারীদের কোনো রকম সহায়তা না করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও এ বিষয়ে আলোচনা করা যেতে পারে, যাতে তরুণ প্রজন্ম চোরাচালানের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত থাকে এবং এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চোরাচালান দমনের জন্য অপরিহার্য, কারণ এটি একটি আন্তঃসীমান্ত অপরাধ। বর্তমান সময়ে চোরাকারবারীরা আধুনিক এবং মর্ডান টেকনোলজি ব্যবহার করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাই সীমান্তরক্ষী বাহিনীকেও প্রযুক্তিগত আধুনিকীকরণ অপরিহার্য। স্মার্ট বর্ডার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করা যেতে পারে, যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সন্দেহজনক কার্যকলাপ শনাক্ত করতে পারবে এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করবে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এই লড়াইয়ে আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। চোরাচালান সত্যিই একটি দেশের জন্য নীরব ঘাতক। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকার, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং সাধারণ জনগণের সম্মিলিত ও অবিচল প্রচেষ্টা অপরিহার্য। একটি চোরাচালানমুক্ত সীমান্ত কেবল দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিই আনবে না, বরং একটি নিরাপদ ও স্থিতিশীল সমাজ গঠনেও সহায়তা করবে। একটি সমৃদ্ধ ও নিরাপদ বাংলাদেশের জন্য চোরাচালানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কোনো আপস নয়, প্রয়োজন সমন্বিত, অবিচল এবং দরদ ভরা পদক্ষেপ।

ভূঁইয়া শফি : সাংবাদিক ও কলামিস্ট