রাজধানীর রিকন্ডিশন্ড গাড়ির ব্যবসায়ীরা চাঁদাবাজদের নতুন টার্গেটে পরিণত হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলছেন, দুর্বৃত্তদের অনেকে দেশের বাইরে থেকে, বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে ফোন করে চাঁদা দাবি করছে। চাঁদা না দিলে পরিবারের সদস্যদের অপহরণের হুমকিও দিচ্ছে এই চক্র।
গত ছয় মাসে অন্তত ৪০ জন গাড়ি ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা চেয়ে ফোন করা হয়েছে। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত ছয়জন ব্যবসায়ী ভাটারা থানায় জিডি করেছেন। যাদের টার্গেট করা হয়েছে, তাদের অধিকাংশের শোরুম রাজধানীর প্রগতি সরণি, বারিধারা ও আশপাশের এলাকায়।
হুমকি পাওয়া চারজন ব্যবসায়ী জানান, পাঁচ থেকে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে বিদেশি নম্বর থেকে কল করা হচ্ছে। এমনকি ছেলেমেয়েরা কোথায় পড়ছে, সেই তথ্য জানিয়ে অপহরণের হুমকি দেওয়া হয়। অধিকাংশ ঘটনায় কাশেম দ্বীপ নামে একজন তার পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদা দাবি করছেন। কিছু ঘটনায় দাদা বিনোধ ও পটকা বাবুর নামও এসেছে। পুলিশ জানিয়েছে, দ্বীপ ও বিনোধ দেশের বাইরে থাকেন।
বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভেহিক্যালস ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বারভিডা) সভাপতি আবদুল হক বলেন, "এত বছর ধরে গাড়ি ব্যবসা করছি, কখনও ধারাবাহিকভাবে এ ধরনের হুমকি ব্যবসায়ীরা পাননি। ছয় মাস ধরে এটা চলছে। প্রথমে ভেবেছিলাম দুষ্টু ছেলেপেলে এমনটা করছে। পরে দেখি শোরুমের সামনে ককটেল মারতে শুরু করল। এখন পর্যন্ত ৪০ জন এমন হুমকি পেয়েছে।
দুবাইয়ে বসে মাফিয়া স্টাইলে গাড়ি ব্যবসায়ীদের হুমকি দিচ্ছে দ্বীপ নামে একজন। সে নিজেকে সাবেক যুবলীগ নেতা বলে পরিচয় দেয়।" তিনি আরও বলেন, তারা পুলিশ প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করলেও চাঁদাবাজদের হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন বন্ধ হয়নি। বাধ্য হয়ে তারা গত রোববার মানববন্ধন করেছেন।
সর্বশেষ ১৫ অক্টোবর বারিধারায় বেগ অটোর সামনে চাঁদার দাবিতে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এখন পর্যন্ত ১২টি গাড়ির শোরুমে একই আদলে হামলা হয়েছে, কিন্তু জড়িত একজনকেও এখনো (মঙ্গলবার) গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) তালেবুর রহমান জানিয়েছেন, চাঁদাবাজির ঘটনায় কেউ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে পুলিশ অবশ্যই তদন্ত করে দেখবে।
এদিকে, ১৩ অক্টোবর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় প্রক্সিমা বায়িং হাউসের মালিক আলী নূর ইসলাম জীবনকে জিম্মি করে একটি চাঁদাবাজ চক্র। মুক্তিপণ হিসেবে প্রথমে ২০ লাখ টাকা দাবি করা হলেও পরে ১০ লাখ টাকায় নেমে আসে। আলী নূর তাৎক্ষণিকভাবে এত টাকা দিতে না পারায় তার মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব থেকে ৭৫ হাজার টাকা, নগদ এক লাখ টাকা, তিনটি মোবাইল ফোন, একটি ল্যাপটপ ও টয়োটা ব্র্যান্ডের একটি গাড়ি নিয়ে তিন সদস্যের চক্রটি পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় ভাটারা থানায় চাঁদাবাজির মামলার পর মঙ্গলবার যশোর থেকে গাড়িটি উদ্ধার করেছে পুলিশ।
ভাটারা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, চাঁদাবাজ চক্রটির দলনেতা নিয়াজুর রহমান ও তার স্ত্রীকে যশোর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিয়াজুর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে এবং তার স্ত্রী শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। প্রায় একই ধরনের ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা আছে। অভিনব উপায়ে ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে চাঁদাবাজি করছে তারা। তাদের সঙ্গে আর কারা জড়িত, তা জানতে তদন্ত চলছে।
মঙ্গলবার রাতে ব্যবসায়ী আলী নূর ইসলাম বলেন, এক বন্ধুর মাধ্যমে নিয়াজুরের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তবে কোনো ঘনিষ্ঠতা ছিল না। নমুনা দেখানোর কথা বলে নিয়াজুর তাকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় ডেকে নিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে ছুরির আঘাত লাগে।
ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত চাঁদার দাবিতে যেসব গাড়ি ব্যবসায়ীকে হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং শোরুমের সামনে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—কার সিলেকশন, বেগ অটো, টারবো অটো, হ্যালো কারস, বিসমিল্লাহ কারস, ওশান মোটরস, এলএনবি কার, বিশ্বাস ইম্পোর্টার্স এবং ওয়ালি কার।
তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, যেসব নম্বর থেকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে, সবই দেশের বাইরের নম্বর। থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিট তদন্তে নেমেছে। এছাড়া যে মোটরসাইকেল দিয়ে এসে ককটেল ফাটানো হচ্ছে, সেটির নম্বরও ভুয়া।
পুলিশের আরেক কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের অপরাধীদের শনাক্ত করতে প্রযুক্তিগত তদন্ত করার সক্ষমতা থানা-পুলিশের নেই। তদন্তের একটি পর্যায় পর্যন্ত গিয়ে তাদের থেমে থাকতে হচ্ছে। এই কর্মকর্তার ভাষ্য, নতুন নানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পুলিশকে এখনো যেতে হচ্ছে। পুরোপুরি মনোবল ফেরত আসেনি। অভিযান চালাতে গিয়ে হামলার মুখেও পড়তে হচ্ছে।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ যাতে ঝটিকা মিছিল বের করতে না পারে, সেদিকে বাড়তি মনোযোগ রাখতে হচ্ছে। জুলাইয়ের আন্দোলনের মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারে নিয়মিত অভিযান চালাতে হয়। এর সঙ্গে প্রায় প্রতিদিন নানা দাবিতে সড়ক অবরোধ, ঘেরাও এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। পাশাপাশি অপরাধ চক্রে নতুন মুখ আসায় তাদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করে আইনের আওতায় আনতে হচ্ছে।


Comments