Image description

একসময় বাংলার গ্রামীণ জীবনের অন্যতম বিনোদন ছিল হা-ডু-ডু খেলা। গ্রামের কাঁচা রাস্তা, খোলা মাঠ, কিংবা বাগানের প্রান্তে প্রতিদিন বিকেলে জমত এই খেলার উৎসবমুখর আসর। ঢাক-ঢোল পেটানো, দর্শকদের উল্লাস আর খেলোয়াড়দের শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই—সব মিলিয়ে গ্রামজীবনে এনে দিত প্রাণচাঞ্চল্য।

সিরাজগঞ্জের প্রতিটি উপজেলায়, বিশেষ করে কাজিপুরে, ছিল এই খেলার দারুণ জনপ্রিয়তা। কিন্তু কালের আবর্তে সেই ঐতিহ্য আজ প্রায় বিলুপ্ত। এখন গ্রামবাংলার মাঠে হা-ডু-ডুর জায়গা দখল করেছে ক্রিকেট, ফুটবল, টেলিভিশন ও মোবাইল গেমস।

হা-ডু-ডু ছিল শুধু একটি খেলা নয়—এটি ছিল বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আবেগের প্রতীক। কিশোর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক, সবাই মেতে উঠত এই খেলায়। উৎসব বা পালা-পার্বণে হতো গ্রাম-গ্রামে দল গঠন করে প্রতিযোগিতা। বিজয়ী দলকে দেওয়া হতো পুরস্কার, আবার কোথাও কোথাও হতো গরু বা খাসি জবাই করে খাওয়া-দাওয়া।

তবে খেলাকে ঘিরে কখনো কখনো দু’পক্ষের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদও ঘটত—তবুও এই খেলাই ছিল গ্রামের মানুষকে একত্রিত করার অনন্য মাধ্যম।

কাজিপুর উপজেলার চর গিরিশ ইউনিয়নের শতবর্ষী রহিম ও রফিক এখনো স্মৃতি রোমন্থন করেন— “আগে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই মিলে হা-ডু-ডু দেখতে জড়ো হতো। এখন এসব খেলা শুধু স্মৃতি হয়ে গেছে।”
মায়েজবাড়ির বয়োবৃদ্ধ করিম বললেন, “এই খেলায় প্রাণ ছিল, ঐক্য ছিল। আবার যদি সেই দিনগুলো ফিরত!”
কামারখোন্দ গ্রামের রুবেল বলেন, “এখন নানা রঙের খেলা বেড়েছে, কিন্তু হারিয়ে গেছে গুডু গুডু খেলা (হা-ডু-ডু)।”
একসময় কাজিপুরের বিকেল মানেই ছিল বৌচি, কানামাছি, দারিয়াবান্ধা, গোল্লাছুট আর হা-ডু-ডু খেলার প্রতিযোগিতা। এখন সেই দৃশ্য আর দেখা যায় না।

১৯৭২ সালে হা-ডু-ডুর নাম পরিবর্তন করে “কাবাডি” রাখা হয় এবং একে বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। বর্তমানে এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও জনপ্রিয় খেলাগুলোর একটি। কিন্তু দুঃখজনক বিষয়—যে গ্রাম থেকে এই খেলার জন্ম, সেখানেই আজ তা বিলুপ্তপ্রায়।

গ্রামীণ খেলা শুধু বিনোদন নয়, এটি ছিল সামাজিক বন্ধনের মাধ্যম, শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির উৎস এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক। কিন্তু টেলিভিশন, মোবাইল গেমস ও শহরমুখী জীবনের প্রভাবে নতুন প্রজন্ম হারিয়ে ফেলছে সেই ঐতিহ্যের ছোঁয়া।
তবু আশার আলো এখনো নিভে যায়নি। বাংলাদেশের অনেক গ্রামে আজও কিছু প্রবীণ মানুষ কাবাডিকে মনে-প্রাণে ভালোবাসেন। তারা বিশ্বাস করেন— একদিন হয়তো আবার বাংলার মাঠে, উৎসবের দিনে, ধুলোমাখা মাটিতে প্রতিধ্বনিত হবে সেই চিরচেনা ডাক—“হা... ডু... ডু...”