Image description

একদিকে চা বাগান অন্যদিকে হাওর অধ্যুষিত মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার ছোট ধামাই মণিপুরী সম্প্রদায়ের দেড় শতাধিক তাঁত পরিবারের মধ্যে চলছে হাহাকার। তাঁত শিল্পের যাচ্ছে দুর্দিন।এ পেশা থেকে অনেকেই আজ হাত গুটিয়ে নিয়েছে। ইতিমধ্যে তাঁত শিল্প সরকারের পক্ষ থেকে জিআই পণ্য হিসেবে গণ্য হয়েছে। তবে জিআই পণ্য গণ্য হওয়ার আগেই অনেকেই এ শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

১৯৭৪ সালে ছোট ধামাই মণিপুরী তাঁত শিল্পের বাজারজাত শুরু হয়। এর আগে তারা নিজেরাই ব্যবহারের জন্য পোশাক তৈরি করত। বাজারজাত শুরুর পর থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকা হতে লোকজন ছোট ধামাই থেকে তাদের তৈরি চাদর, শাড়ী, ওড়না, সিটকভার, বেডকভার, মাফলার, ওয়াইস্ট কোট সহ বিভিন্ন ডিজাইনের পোশাক কিনে নিত।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিশ্বে রকমারি ডিজাইনের পোশাক বের হয়ে এ শিল্পে ধস নেমে আসে। তাঁত শিল্পের ওপর নির্ভরশীল বিজয়া সিনহা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, এখন আর শাড়ী, ওড়না তৈরি করি না। কারণ, কারিগর নেই, সুতা পাওয়া যায় না। কমলগঞ্জ থেকে সুতা আনতে হয়। দামও অনেক বেশি। এখন একমাত্র নিজের ব্যবহারের জন্য মনিপুরি ফানেক তৈরি করি। একটা ফানেক তৈরিতে ২ মোটা সুতা লাগে। ২ মোটা সুতার দাম ৪০০/- টাকা। প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা কাজ করে ৪ দিনে একটা ফানেক তৈরি করা যায়। ১ টি ফানেক ৬০০/৭০০ টাকা বিক্রি হয়। বিক্রয় মূল্যের চেয়ে শ্রম ও সুতার দাম মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় আগ্রহ হারিয়েছে তাঁত শিল্পীরা। শাড়ীর দাম নকশা, বুনন ও কাপড়ের উপর নির্ভর করে ৬ শত থেকে ৬ হাজার টাকা হতে পারে। বিশেষ নকশার শাড়ী আরও বেশি দাম হতে পারে।

এ ছাড়া বর্তমানে সব সম্প্রদায়ের মেয়েরা জিন্সের প্যান্ট ও জ্যাকেট পরে। শাড়ি, ওড়না, চাদর পরে না, তাই তাঁত শিল্পে বেহাল অবস্থা।

তাঁত শিল্পী সানানু চনু বলেন, উৎপাদন খরচ এখন বেশি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। যেমন সুতা, রং, বিদ্যুৎ সহ অন্যান্য মালামাল এখন বেশি দামে কিনতে হয়।

তাঁতের একটি শাড়ী তৈরিতে ২ জন শ্রমিকের প্রতিদিন ৪/৫ ঘণ্টা কাজ করে ১০/১২ দিন সময় লাগে। ১ টি শাড়ীতে মজুরি আসে ৪/৫ হাজার টাকা। আর একটি শাড়ী বর্তমান বাজারে সেই পরিমাণ দামে বিক্রি হয় না। গুণগত মানের সঙ্গে বাজারে দাম পাওয়া যায় না। ছোট ধামাই গ্রামের এক সময় সকল পরিবারেই হ্যান্ডলুম ছিল। এ হ্যান্ডলুম দিয়ে উন্নতমানের কাজ করা সম্ভব হয় না। উন্নত পোশাক তৈরিতে তাঁত মেশিন প্রয়োজন। অর্থের অভাবে অনেকেই তাঁত মেশিন তৈরি করতে পারে না।

তাঁত শিল্পের প্রশিক্ষক খোইনৌ মিতৈ জানান, তাঁত শিল্পের প্রচুর চাহিদা এখনও আছে। তবে দক্ষ শ্রমিক নেই। আগেকার আমলের ডিজাইনের উৎপাদিত পণ্য এখন বাজারে চলে না। নতুন ডিজাইনের কাজ অনেকেই জানে না। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ছোট ধামাই মনিপুরী পাড়ায় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তেমন কোনো কাজ হয় নি। এটি একটি ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প। দেশের অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রশাসনের উদ্যোগে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ও আধুনিক স্বয়ংক্রিয় তাঁতমেশিন (পাওয়ারলুম) বিতরণ সহ ভর্তুকি প্রদানের দাবি জানাচ্ছি।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রুহেল উদ্দিন জানান, আগেকার আমলের হ্যান্ডলুম দিয়ে কাজ করতে এখন অনেকের আগ্রহ নেই। তাই, সরকারের পক্ষ থেকে আধুনিক যন্ত্রপাতি প্রদানের মাধ্যমে এ শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার বাবলু সুত্রধর জানান, ছোট ধামাই তাঁত শিল্প সংশ্লিষ্ট কেউ আমার সাথে যোগাযোগ করেনি। যোগাযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সর্বাত্মক চেষ্টা করবো।