চুল্লিতে আগুন, হাতে মাটি; ভদ্রাসনের কুমাররা বাঁচিয়ে রেখেছেন শত বছরের ঐতিহ্য
চুল্লিতে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে পোড়া মাটির গন্ধ। হাতে মাটি মেখে ঘুরছে চাক, তাতে গড়ে উঠছে হাঁড়ি, পাতিল, কলস যেন মাটির ভেতর থেকে জেগে উঠছে জীবন্ত শিল্প। মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ভদ্রাসন ইউনিয়নে এমন দৃশ্য এখন প্রতিদিনের। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়েছে শত বছরের ঐতিহ্যবাহী মাটির হাঁড়ি-পাতিল তৈরির মৌসুম। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা এই কুমারশিল্প আজও টিকিয়ে রেখেছেন কয়েকটি পরিবার হয়তো মুনাফার আশায় নয়, ভালোবাসা আর ঐতিহ্যের টানে।
ভদ্রাসনের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে দেখা যায়, কুমাররা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মাটির সঙ্গে যুদ্ধ করে। বালু ও মাটি মিশিয়ে তৈরি হয় বিশেষ মিশ্রণ, এরপর হাতে তৈরি হয় হাঁড়ি-পাতিল। রোদে শুকিয়ে নেওয়ার পর ‘নিউক’ বা চুল্লিতে পুড়িয়ে সেটিই হয়ে ওঠে ব্যবহারযোগ্য পণ্য যার প্রতিটি ফোঁটে মিশে থাকে কুমারদের ঘাম, শ্রম আর শিল্পীসত্তা।
স্থানীয় কুমার শ্রীকৃষ্ণ পাল বলেন, এই পেশাই আমাদের জীবনের গল্প। ছোটবেলা থেকে মাটির সঙ্গেই বড় হয়েছি। এখন বাজারে প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়ামের দাপট তবু কেউ কেউ আজও মাটির হাঁড়ি ছাড়া রান্না করেন না। এই ভালোবাসাই আমাদের টিকিয়ে রেখেছে।
আরেক কুমার প্রদীপ কুমার পাল বলেন, ভালো মাটি পেতে অনেক কষ্ট করতে হয়। মাটি তৈরি, শুকানো, নিউক বানানো সব মিলিয়ে ১৫-২০ দিনের পরিশ্রমে তৈরি হয় এক ব্যাচ হাঁড়ি-পাতিল। লাভ কম, কিন্তু যখন দেখি মানুষ এখনও আমাদের জিনিস ব্যবহার করে, তখন সব কষ্ট ভুলে যাই।
স্থানীয় প্রবীণরা জানান, একসময় ভদ্রাসনের কুমারদের তৈরি হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি হতো শিবচর, কালকিনি, রাজৈর, কাজিরহাটসহ গ্রেটার ফরিদপুরের বিভিন্ন হাটে। এখন সেই বাজার অনেকটা হারিয়ে গেছে, কিন্তু কিছু কুমার আজও অনলাইন, মেলা ও স্থানীয় বাজারে তাঁদের পণ্য বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
শিবচর উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির এক কর্মকর্তা বলেন, এই কুমারশিল্প শুধু পেশা নয় এটা শিবচরের সংস্কৃতি, মানুষের শিকড়। যদি সরকারি বা স্থানীয় সহায়তা মেলে, এই ঐতিহ্য আবারও নতুন রূপে ফিরবে।
আজও ভদ্রাসনের কুমারদের হাতে যে মাটি ঘুরে ঘুরে হাঁড়িতে রূপ নেয়, সেখানে লুকিয়ে আছে গ্রামের পুরোনো দিনের স্মৃতি আর মানুষের মায়া। মাটির হাঁড়ি শুধু রান্নার পাত্র নয় এ যেন সময়ের সাক্ষী, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলা ঐতিহ্যের নিঃশব্দ ভাষা।




Comments