Image description

নাটকীয় রাজনৈতিক উত্থান-পতনের পর মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে ভারতে স্ব-নির্বাসনে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার রাজনৈতিক জীবন যেন ট্র্যাজেডি, নির্বাসন এবং ক্ষমতার এক জটিল উপাখ্যান, যা বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক উত্থান ছিল সংগ্রামী। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে শীর্ষ আরোহণের পর ক্ষমতা থেকে তার পতন এবং ভারতে স্ব-নির্বাসন এক বিস্ময়কর ঘটনা। গত বছর আগস্টে এক ছাত্র অভ্যুত্থানে টানা ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের পর তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন এবং অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে আশ্রয় নেন।

২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে তার সরকারকে উৎখাতকারী ছাত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর 'হিংস্র দমন-পীড়নের' জন্য আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিদেশে থাকা অবস্থাতেই তাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। মূলত বিক্ষোভকারীদের হত্যায় উসকানি, হত্যার নির্দেশ এবং প্রতিবাদ দমনে মারণাস্ত্র, ড্রোন ও হেলিকপ্টার ব্যবহারের নির্দেশের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হন। আদালত জানায়, তিনি ছাত্র বিক্ষোভকারীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই মৃত্যুদণ্ড এখন তাকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যেতে পারে, যদি ভারত তাকে প্রত্যর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত তাকে বিচারের মুখোমুখি করার জন্য প্রত্যর্পণের দাবি জানালেও, শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

বাংলাদেশের রাজনীতি বিশেষজ্ঞ মোবাশ্বার হাসান এই ঘটনাকে "অসাধারণ গল্প" হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, "জনগণের ক্রোধ থেকে বাঁচতে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। ... জনগণ, শক্তি, সবাই তার বিপক্ষে গিয়েছিল কারণ তিনি সীমা অতিক্রম করেছিলেন। তিনি হত্যা করেছেন, তার নির্দেশ ছিলো যত বেশি মানুষকে হত্যা করার।"

১৯৭৫ সালের আগস্টে এক সামরিক অভ্যুত্থানে সপরিবারে তার পিতা, মাতা এবং তিন ভাই নিহত হন। সে সময় পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় তিনি ও তার বোন প্রাণে বেঁচে যান। এই ট্র্যাজেডি তাকে রাজনীতিতে ঠেলে দেয়। আওয়ামী লীগের হাল ধরে দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পাড়ি দিয়ে ২০০৮ সালে তিনি যখন আবার ক্ষমতায় ফেরেন, তখন তাকে আরও বেশি দৃঢ়সংকল্প এবং নিজের অবস্থান স্থায়ীভাবে সুরক্ষিত করতে বদ্ধপরিকর এক নেতা হিসেবে দেখা যায়। পরবর্তী ১৫ বছর তিনি শক্তিশালী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি কঠোর হস্তে দেশ শাসন করেন এবং এই সময়ে তিনি ভারতকেও কৌশলগত সহায়তা প্রদান করেন।

তবে এই উন্নয়নের একটি চড়া মূল্য ছিল। মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করেছিল যে, তার সরকার এক একদলীয় ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। রাজনৈতিক সহিংসতা, ভোটারদের ভয় দেখানো এবং বিরোধী ও গণমাধ্যম কর্মীদের হয়রানির মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকলেও, ভারতের আইনে একটি ‘রাজনৈতিক অপরাধ’ বিষয়ে ব্যতিক্রম ধারা আছে, যা এই ধরনের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রকে প্রত্যর্পণ প্রত্যাখ্যান করার অনুমতি দেয়।

সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক অনিল ত্রিগুণায়াত মনে করেন, ভারতকে এটি (প্রত্যর্পণ) রাজনৈতিক অপরাধ হিসেবে দেখতে হবে, মানবতাবিরোধী অপরাধ নয়, যার জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তবে যেহেতু তার সব আইনি প্রতিকার এখনো শেষ হয়নি, তাই ভারত তাকে দ্রুত পাঠানোর কোনো তাড়া দেখাবে না বলে তিনি মনে করেন।

এদিকে, ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতকে ‘বিলম্ব না করে’ শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করার আহ্বান জানিয়েছে। হাসিনার এই পতন এবং মৃত্যুদণ্ডাদেশ আগামী ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশের নির্বাচনের জন্য এক টানটান পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বিষাক্ত যুগের সমাপ্তি, নাকি কেবল অনিশ্চয়তার এক নতুন অধ্যায়ের শুরু— সেই প্রশ্ন এখন সামনে আসছে।