২০১২ সালের অক্টোবর মাস। তালেবানের ছোড়া একটি বুলেট মালালা ইউসুফজাইয়ের খুলির সবচেয়ে পাতলা হাড় ভেঙে চুরমার করে মস্তিষ্কে ঢুকে পড়েছিল। এরপরের ঘটনাপ্রবাহ ছিল অত্যন্ত নাটকীয় ও সংকটপূর্ণ। পেশোয়ারের হাসপাতালে কোমায় থাকা অবস্থায় মালালার শারীরিক অবস্থার এতটাই অবনতি ঘটেছিল যে, চিকিৎসকরা নিশ্চিত হতে পারছিলেন না ১৫ বছর বয়সী এই কিশোরী আদৌ বাঁচবেন কি না।
পরবর্তীতে সেই কিশোরীই হয়ে ওঠেন বিশ্বজুড়ে নারী শিক্ষার অগ্রদূত ও সাহসের প্রতীক। কিন্তু তার বেঁচে ওঠার নেপথ্যে ছিল চিকিৎসকদের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা ও সঠিক সময়ে নেওয়া কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত। ২০১৩ সালে এবিসি নিউজের এক প্রতিবেদনে মালালার চিকিৎসকরা সেই শ্বাসরুদ্ধকর সময়ের বর্ণনা দেন।
২০১২ সালের ৯ অক্টোবর, মঙ্গলবার। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় স্বাত উপত্যকায় স্কুলবাসে করে ফিরছিলেন মালালা। বন্দুকধারীর লক্ষ্য ছিল সুনির্দিষ্ট। বাসে উঠে নাম ধরে ডাকার পর খুব কাছ থেকে একটি কোল্ট .৪৫ পিস্তল দিয়ে তিনটি গুলি ছোড়া হয়। এর মধ্যে একটি গুলি মালালার বাম চোখের ওপর দিয়ে ঢুকে চামড়ার নিচ দিয়ে গিয়ে কাঁধে আঘাত করে।
হামলার খবর মুহূর্তেই ২০০ মাইল দক্ষিণে পাকিস্তানের সেনা সদর দপ্তরে পৌঁছে। সেনাপ্রধান জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানি মালালার পূর্বপরিচিত ছিলেন। ঘটনা শোনামাত্র তিনি বুঝতে পারেন, এটি সাধারণ কোনো হামলা নয়। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে মালালাকে পেশোয়ারের সামরিক হাসপাতালে স্থানান্তরের জন্য হেলিকপ্টার পাঠানোর নির্দেশ দেন। তালেবান অধ্যুষিত এলাকায় সাধারণত বেসামরিক কাউকে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করা বিরল ঘটনা ছিল, কিন্তু মালালার ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্তই তার জীবন বাঁচাতে বড় ভূমিকা রাখে।
পেশোয়ারের হাসপাতালে মালালার চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন সেনাবাহিনীর নিউরোসার্জন কর্নেল জুনেইদ খান। প্রথমে মালালাকে স্থিতিশীল মনে হলেও চার ঘণ্টা পর তার মস্তিষ্কের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। গুলির আঘাতে মস্তিষ্ক ফুলে উঠছিল। ডা. খান বুঝতে পারেন, মস্তিষ্কের চাপ কমাতে খুলির একটি অংশ কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
তবে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মালালার পরিবার। ডা. জুনেইদ খানকে দেখতে বেশ তরুণ মনে হওয়ায় মালালার বাবা তার ওপর পুরোপুরি ভরসা করতে পারছিলেন না। তিনি চাইছিলেন মালালাকে দ্রুত দুবাই নিয়ে যেতে। কিন্তু সময় ছিল খুব কম। ডা. খান স্পষ্ট জানিয়ে দেন, অবিলম্বে অস্ত্রোপচার না করলে মালালাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।
ডা. খান বলেন, ‘মস্তিষ্কের যে জায়গায় আঘাত লেগেছিল, তা কথা বলা এবং ডান হাত-পায়ের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে। অস্ত্রোপচারে সামান্য ভুল হলে তিনি চিরতরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে পারতেন বা কথা বলার শক্তি হারাতে পারতেন।’
মধ্যরাতে শুরু হয় সেই জটিল ক্র্যানিওটমি অস্ত্রোপচার। ডা. জুনেইদ ও তার দল সফলভাবে খুলির অংশ অপসারণ করে জমাটবাঁধা রক্ত পরিষ্কার করেন। বার্মিংহামের শিশু নিবিড় পরিচর্যা বিশেষজ্ঞ ডা. ফিওনা রেইনল্ডস পরবর্তীতে বলেন, ‘জুনেইদ সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করেছিলেন। কোনো সন্দেহ নেই, তিনিই মালালার জীবন বাঁচিয়েছেন। তিনি একজন সত্যিকারের নায়ক।’
পরবর্তীতে জেনারেল কায়ানি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘মালালা আজ বেঁচে আছেন মূলত দুজনের কারণে—সেই সার্জন যিনি ভোরের আলো ফোটার আগেই অস্ত্রোপচার করেছিলেন এবং সেনাপ্রধান হিসেবে দ্রুত হেলিকপ্টার পাঠানোর সিদ্ধান্ত।’
মৃত্যুকে জয় করে ফেরা মালালা আজ বিশ্বজুড়ে এক অনুপ্রেরণার নাম। কিন্তু সেই রাতে পেশোয়ারের হাসপাতালে নেওয়া চিকিৎসকদের সাহসী পদক্ষেপ ছাড়া এই ইতিহাস হয়তো ভিন্ন হতে পারত।
সূত্র: এবিসি নিউজ




Comments