চলতি বছরটি বৈশ্বিক এভিয়েশন খাতের জন্য এক গভীর ক্ষত ও দীর্ঘশ্বাসের নাম। বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ১৩টি বড় ধরনের বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৪৭০ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে যেমন রয়েছে যাত্রীবাহী বিশাল উড়োজাহাজ, তেমনি রয়েছে সামরিক যুদ্ধবিমান ও কার্গো ক্যারিয়ার।
বছরের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডিটি ঘটে গত ১২ জুন ভারতের আহমেদাবাদে। এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার (ফ্লাইট ১৭১) উড্ডয়নের মাত্র এক মিনিটের মাথায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আছড়ে পড়ে। এই মর্মান্তিক ঘটনায় বিমানের ২৪১ জন আরোহীসহ মোট ২৬০ জন প্রাণ হারান। বিশেষজ্ঞরা একে ২০২০-এর দশকের সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০২৫ সাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভয়াবহ দুর্ঘটনার কারণে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণ চলাকালে স্কুল ভবনটির ওপর বিধ্বস্ত হয়। এই ঘটনায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় একের পর এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে নিহতের সংখ্যা ৩৪-এ পৌঁছায়।
তবে এই শোকের মাঝেও মানবতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন দুই শিক্ষিকা—মাহরীন চৌধুরী ও মাসুকা বেগম। বিমানটি আছড়ে পড়ার মুহূর্তে নিজেদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে তারা শ্রেণিকক্ষ থেকে শিশুদের সরিয়ে নিতে ঝাপিয়ে পড়েন। আগুন ও ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে তারা নিজেরা গুরুতর আহত হন এবং পরে হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাদের এই বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সরকার তাদের মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করেছে।
বছরের শুরুতে ২৯ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে আমেরিকান এয়ারলাইনসের একটি যাত্রীবাহী বিমানের সাথে সেনাবাহিনীর ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারের আকাশেই সংঘর্ষ ঘটে, যাতে ৬৭ জন নিহত হন। এরপর ৩১ জানুয়ারি ফিলাডেলফিয়ায় একটি মেডিকেল জেট বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারান বিমানের আরোহীসহ ভূমিতে থাকা আরও দুই ব্যক্তি। ৬ ফেব্রুয়ারি আলাস্কায় ১০ জন এবং ১৭ মার্চ হন্ডুরাসে সাগরে বিমান পড়ে ১২ জন নিহত হন।
বছরের মাঝামাঝি ২৪ জুলাই রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় একটি বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ৪৮ জন আরোহীর সবাই প্রাণ হারান। ২৮ অক্টোবর কেনিয়ায় ১১ জন এবং ৪ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ইউপিএস কার্গো বিমান দুর্ঘটনায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া হংকং, দুবাই এবং সবশেষে ২৩ ডিসেম্বর তুরস্কে লিবিয়ার সামরিক প্রধানসহ ৮ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বছরের দুর্ঘটনার তালিকা দীর্ঘতর হয়।
বিমানের আধুনিক প্রযুক্তি সত্ত্বেও কেন বারবার এমন বিপর্যয় ঘটছে, তা নিয়ে দেখা দিয়েছে তীব্র বিতর্ক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যান্ত্রিক ত্রুটি ও প্রতিকূল আবহাওয়ার পাশাপাশি মানবিক ভুল এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ফ্লাইং জোনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাই এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ। বিশেষ করে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির পর বেসামরিক এলাকায় সামরিক প্রশিক্ষণের ঝুঁকি নিয়ে নতুন করে পর্যালোচনার দাবি উঠেছে।
২০২৫ সালের এই রক্তাক্ত ইতিহাস বিশ্ব এভিয়েশন কর্তৃপক্ষকে নিরাপত্তা কাঠামো নতুন করে সাজাতে বাধ্য করছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।




Comments