| সংগৃহীত ছবি
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো শোনালেও, কিছু গবেষক সত্যিই পরীক্ষাগারে তৈরি মস্তিষ্ক ব্যবহার করে নতুন ধরনের কম্পিউটার তৈরির চেষ্টা করছেন এবং এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিও হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের একদল বিজ্ঞানী বায়োকম্পিউটিংয়ের এই অদ্ভুত যাত্রায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যেখানে একদিন 'জীবন্ত' সার্ভার দিয়ে ডেটা সেন্টার পরিচালনার স্বপ্ন দেখা হচ্ছে। এই 'জীবন্ত' সার্ভারগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) যেভাবে শেখে তার কিছু দিক অনুকরণ করবে এবং প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় অনেক কম শক্তি ব্যবহার করে কাজ করবে।
প্রচলিত ইলেকট্রনিক কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারের বিপরীতে, ফাইনালস্পার্ক ল্যাবের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ড. ফ্রেড জর্ডান তার বায়োকম্পিউটারের উপাদানকে 'ওয়েটওয়্যার' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সহজ কথায়, এটি গবেষণাগারে স্টেম সেল থেকে উৎপাদিত নিউরন দিয়ে তৈরি 'অর্গানয়েড' বা নিউরন ও সহায়ক কোষের ক্লাস্টার। এই অর্গানয়েডগুলোকে ইলেকট্রোডের (তড়িৎদণ্ড) সঙ্গে যুক্ত করে মিনি কম্পিউটার হিসেবে ব্যবহার করার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
ড. জর্ডান স্বীকার করেন যে, বায়োকম্পিউটিংয়ের ধারণাটি অনেকের কাছে অদ্ভুত লাগতে পারে। তিনি বলেন, "বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে মানুষ এই ধারণার সঙ্গে অনেক আগেই পরিচিত হয়েছে। যখন আপনি বলেন যে, আমি একটি নিউরনকে ছোট একটি যন্ত্রের মতো ব্যবহার করব, তখন এটি আমাদের মস্তিষ্ককে ভিন্নভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি দেয় এবং আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ দেয়।"
ফাইনালস্পার্ক ল্যাবে এই বায়োকম্পিউটার তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় মানুষের ত্বক থেকে নেওয়া স্টেম সেল থেকে, যা জাপানের একটি ক্লিনিক থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। দাতা-ব্যক্তিদের পরিচয় অজ্ঞাত হলেও বর্তমানে অনেক স্বেচ্ছাসেবী স্টেম সেল দানে আগ্রহী। ড. জর্ডান জানান, তারা কেবল অফিশিয়াল সরবরাহকারীর স্টেম সেলই ব্যবহার করেন, কারণ কোষের মান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
স্টেম সেল থেকে তৈরি নিউরন এবং সহায়ক কোষ মিলে কয়েকটি ক্লাস্টার বা গুচ্ছ তৈরি করা হয়, যা একেকটি 'মিনি ব্রেইন' হিসেবে কাজ করে। মানব মস্তিষ্কের জটিলতা এতে না থাকলেও, এর গাঠনিক উপাদান একই রকম। কয়েক মাসের প্রক্রিয়ার পর এই মিনি ব্রেইনগুলো তড়িৎদ্বারের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য প্রস্তুত হয় এবং সরল কি-বোর্ড কমান্ডের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাতে সক্ষম হয়।
গবেষকেরা বলছেন, এই মিনি ব্রেইনগুলোর বৈদ্যুতিক সংকেত প্রেরণ ও গ্রহণ করার পদ্ধতি এবং ফলাফল একটি সাধারণ কম্পিউটারে রেকর্ড করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, কি-বোর্ডের একটি বোতাম চাপলে তা তড়িৎদ্বারের মাধ্যমে মিনি-ব্রেইনে বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠায়, এবং যদি মিনি ব্রেইন কাজ করে, তবে স্ক্রিনে ইইজির (ইলেকট্রো এনসেফালোগ্রাম) মতো একটি কার্যকলাপের গ্রাফ দেখা যায়। ড. জর্ডান স্বীকার করেন, তারা এখনো অর্গানয়েডগুলো কী করছে এবং কেন করছে, তা পুরোপুরি বুঝতে পারছেন না। তবে আপাতত, অর্গানয়েড বা মিনি ব্রেইনে বৈদ্যুতিক উদ্দীপনা সৃষ্টি করা গবেষকদের মূল লক্ষ্যগুলোর একটি, যা নিউরনকে শেখার জন্য উদ্দীপিত করে এবং ধীরে ধীরে কর্ম সম্পাদনে সক্ষম করে তোলে।
সাধারণ কম্পিউটার চালু রাখা সহজ হলেও, বায়োকম্পিউটারের ক্ষেত্রে অর্গানয়েড কীভাবে টিকে থাকবে বা শক্তি পাবে, তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইমপিরিয়াল কলেজ লন্ডনের সেন্টার ফর নিউরোটেকনোলজির পরিচালক সাইমন শুল্জ বলেন, "অর্গানয়েডে রক্তনালি নেই। মানব মস্তিষ্কে রক্তনালি আছে যা পুষ্টি সরবরাহ করে। আমরা এখনো সেগুলো ঠিকমতো তৈরি করতে পারি না। এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।"
ফাইনালস্পার্ক গত চার বছরে কিছু অগ্রগতি করেছে; তাদের অর্গানয়েড এখন চার মাস পর্যন্ত বাঁচে। তবে এগুলো মারা যাওয়ার সময় কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটে, যেমন হঠাৎ করে খুব সক্রিয় হয়ে ওঠা। ড. জর্ডান জানান, তারা প্রায় ১ হাজার থেকে ২ হাজার এমন মৃত্যু রেকর্ড করেছেন।
ফাইনালস্পার্ক একমাত্র প্রতিষ্ঠান নয় যারা বায়োকম্পিউটিং নিয়ে কাজ করছে। অস্ট্রেলিয়ার কর্টিক্যাল ল্যাবস ২০২২ সালে ল্যাবরেটরিতে উৎপাদিত নিউরনকে দিয়ে প্রাথমিক কম্পিউটার গেম 'পং' খেলাতে সক্ষম হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরাও 'মিনি-ব্রেইন' তৈরি করছেন। তারা দেখতে চান এগুলো কীভাবে তথ্য প্রক্রিয়া করে, বিশেষ করে আলঝেইমার এবং অটিজমের মতো স্নায়বিক রোগের ওষুধ উন্নয়নের জন্য। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই ধরনের কাজকে আরও দ্রুত ও কার্যকর করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটির ড. লেনা স্মিরনোভা বলেন, 'ওয়েটওয়্যার' বৈজ্ঞানিকভাবে আকর্ষণীয় হলেও এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। তার মতে, "বায়োকম্পিউটিং সিলিকন এআই-এর বিকল্প নয় বরং সহযোগী হিসেবে কাজ করবে। এ ছাড়া রোগ নির্ণয় মডেল তৈরি এবং পরীক্ষাগারে প্রাণীর ব্যবহার কমাতেও সাহায্য করবে।" অধ্যাপক শুল্জও এতে একমত হয়ে বলেন, "আমি মনে করি, এগুলো অনেক ক্ষেত্রে সিলিকনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র খুঁজে পাবে।"
Comments