
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী রিটার্নিং কর্মকর্তারা কী করতে পারবেন এবং কী করতে পারবেন না, তা নির্ধারণ করে দেওয়া থাকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও)। পাশাপাশি তফসিল ঘোষণার পর বিভিন্ন পরিপত্র জারি করে ভোট পরিচালনায় নিযুক্ত এই কর্মকর্তাদের দায়িত্ব জানিয়ে দেওয়া হয়।
তবে আলাদা কোনো আচরণবিধি না থাকায় অনেক সময় রিটার্নিং কর্মকর্তারা দায়িত্বের সীমা অতিক্রম করে পক্ষপাতমূলক আচরণ করেন। করেন ক্ষমতার অপব্যবহার। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়েই নির্বাচন কমিশন (ইসি) এবার প্রথমবারের মতো রিটার্নিং কর্মকর্তাদের জন্য পৃথক আচরণবিধি প্রণয়নের পরিকল্পনা করছে।
ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এতদিন রিটার্নিং কর্মকর্তাদের আচরণ আরপিও এবং নির্বাচনী পরিপত্রের মাধ্যমে নির্ধারিত হতো। কিন্তু এগুলো সবসময় যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। ফলে অনেক কর্মকর্তা আইন না জেনেই সিদ্ধান্ত নেন, যার ফলে মাঠে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। কখনো আবার আইনি বিষয়ে পরামর্শ নিতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়। এসব কারণেই আলাদা আচরণবিধি এখন সময়ের দাবি।
ইসির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বিগত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের মূল কারিগরই ছিল রিটার্নিং কর্মকর্তারা। মাঠের সকল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তারা। এতে অনিয়ম হলেও কমিশনের করার কিছু থাকে না। তারা আইনের অপব্যবহার করেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি ভিন্ন। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ন্যায়পরায়ণতা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের জন্য আচরণবিধি প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। নির্বাচন কমিশনও এটা নিয়ে কাজ করছে। তবে সময় স্বল্পতার কারণে তা করা সম্ভব হবে কিনা, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। কারণ এটি আলোচনার পর্যায়ে আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘রিটার্নিং কর্মকর্তাদের জন্য যদি আলাদা আচরণ বিধিমালা করা যায় তাহলে এটি তাদের নির্বাচনকালীন আচরণ কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে একটি দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে, যা তাদের পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে দায়িত্ব পালন করতে সহায়তা করবে। স্পষ্ট আচরণবিধি থাকার কারণে রিটার্নিং কর্মকর্তারা কোনো দল বা প্রার্থীর প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হবেন না, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা রক্ষা করবে। এছাড়া আচরণবিধি ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি বা অনৈতিক কার্যকলাপ প্রতিরোধে সহায়তা করবে এবং নির্বাচনী আইন মেনে চলা নিশ্চিত করবে।’
এ বিষয়ে একজন নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘রিটার্নিং কর্মকর্তাদের আলাদা আচরণ বিধিমালা তৈরি করার বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একটি প্রস্তাব রয়েছে, যা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। যদি তাদের (রিটার্নিং কর্মকর্তা) জন্য আলাদা আচরণ বিধিমালা করা যায় তাহলে নির্বাচন প্রক্রিয়ার জন্য ভালো হবে। আরপিও সংশোধন হয়ে আসার পর আমাদের হাতে কত সময় থাকবে তার ওপর নির্ভর করবে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের আচরণ বিধিমালা। আর করতে না পারলে আগের নিয়মে চলবে। রিটার্নিং কর্মকর্তা কাদের করা হবে তা নিয়েও আলোচনা চলছে। কারণ রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে প্রায় সকল অংশীজনই পরামর্শ দিয়েছেন ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করার। আবার নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনেরও সুপারিশ রয়েছে। আমরা প্রশাসনিক বিষয়গুলো খতিয়ে দেখছি। সব আসনে দেওয়া সম্ভব না হলেও কিছু আসনে আমরা, আমাদের কর্মকর্তা দিতে পারি কিনা তা নিয়েও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। তবে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা কমিশন বৈঠকেই নেওয়া হবে।
রিটার্নিং কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা আচরণবিধি করার পরিকল্পনাকে কীভাবে দেখছেন- জানতে চাইলে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সাবেক সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মো. আবদুল আলীম ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘এটা খুব দরকার। এই কারণেই যে আরপিও তো আইন। এছাড়া ১৯৯১ সালের নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ বিধান নামে একটা আইন আছে, বর্তমান কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার তা সংশোধন করেছে। আমাদের সুপারিশও আছে এটা করার জন্য। আইন ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য বিধিমালা বা কোড অব কন্ডাক্ট।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের জন্য ৬৬ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে দুজন ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন জেলা প্রশাসক। এছাড়া ৫৯২ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করেন, যাদের মধ্যে ৪৯৫ জনই ছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
এছাড়া ১৪ জন স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক, আটজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ১১ জন জোনাল নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ৫৬ জন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, পাঁচ জন কাস্টমস এক্সিকিউটিভ অফিসার, দুইজন সহকারী কমিশনার (ভূমি) এবং একজন সার্কেল অফিসার নিয়োগ করা হয়েছিল। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের গতবারের মতো এবারও রিটার্নিং কর্মকর্তার সহায়ক হিসেবে নিয়োগ করা হতে পারে।
Comments