শীতকাল আমাদের জীবনে নিয়ে আসে এক স্নিগ্ধ, শীতল পরশ। কিন্তু এই মনোরম আবহাওয়ার একটি চ্যালেঞ্জিং দিক হলো, এটি বাতাস থেকে আর্দ্রতা শুষে নেয়। বাইরের ঠান্ডা আর ভেতরের উষ্ণতা (হিটার/লেপ) মিলে আমাদের ত্বকের স্বাভাবিক জলীয় অংশ দ্রুত বাষ্পীভূত করে দেয়, ফলে ত্বক হয়ে ওঠে রুক্ষ, টানটান এবং ফাটা। ত্বকের এই নীরব সংগ্রাম মোকাবিলার জন্য বছরের পর বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে একটি সরল কিন্তু শক্তিশালী উপাদান—তা হলো গ্লিসারিন।
গ্লিসারিন একটি হিউমেক্ট্যান্ট বা আর্দ্রতাকারক উপাদান। এর মূল ক্ষমতা হলো, এটি জলীয় বাষ্পকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে এবং ত্বকের অভ্যন্তরে তা আটকে রাখতে পারে। শীতে যখন বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকে, তখন গ্লিসারিনের এই কৌশলই আমাদের ত্বককে ভেতর থেকে পুষ্টি জোগায় ও বাইরে একটি অদৃশ্য সুরক্ষা বর্ম তৈরি করে। কিন্তু এই জাদুকরী উপাদানটি ব্যবহার করার কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে, যা না মানলে উপকারের বদলে ক্ষতি হতে পারে। আসুন, জেনে নেওয়া যাক শীতে গ্লিসারিন ব্যবহারের সঠিক কৌশল ও জরুরি সতর্কতাগুলো।
গ্লিসারিন ব্যবহারের পদ্ধতি
গ্লিসারিনের সর্বোত্তম উপকারিতা পেতে হলে এটিকে অবশ্যই কোনো হালকা উপাদানের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
গোলাপ জলের সাথে আদর্শ মিশ্রণ
এটি গ্লিসারিন ব্যবহারের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং নিরাপদ পদ্ধতি। গোলাপ জল ত্বককে শীতল করে এবং এর ঘনত্বকে সঠিক মাত্রায় এনে দেয়।
উপাদান: একটি ছোট বোতলে ১ ভাগ গ্লিসারিন এবং ৩ থেকে ৪ ভাগ গোলাপ জল নিন।
ব্যবহারের সময়: রাতে ঘুমানোর আগে মুখ ধুয়ে এবং শরীর পরিষ্কার করে এই মিশ্রণটি ব্যবহার করুন।
উপকার: এই মিশ্রণ দীর্ঘসময় আর্দ্রতা ধরে রাখে এবং ত্বককে চিটচিটে না করে নরম রাখে। এটি হালকা ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে।
ময়েশ্চারাইজার ও লোশনের সাথে বুস্টার ডোজ
আপনার দৈনন্দিন ব্যবহৃত লোশন বা বডি ক্রিমের কার্যকারিতা আরও বাড়াতে এই কৌশলটি দারুণ কার্যকর।
পদ্ধতি: আপনার হাতের তালুতে যতটুকু লোশন বা ক্রিম নেবেন, তার সাথে মাত্র ২-৩ ফোঁটা গ্লিসারিন যোগ করুন।
ব্যবহারের স্থান: বিশেষ করে কনুই, হাঁটু, গোড়ালি এবং হাত-পায়ের মতো শুষ্ক অংশে ব্যবহার করুন।
ফল: এটি সাধারণ লোশনকে শীতে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে এবং ত্বকের গভীরের শুষ্কতা দূর করে।
ফাটা গোড়ালি ও ঠোঁটের নিরাময়
শীতে ফাটা ত্বক নিরাময়ে গ্লিসারিন অব্যর্থ।
গোড়ালি: রাতে উষ্ণ জলে পা পরিষ্কার করার পর অল্প গ্লিসারিনের সাথে সমপরিমাণ জল ও কয়েক ফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে ফাটা গোড়ালিতে মালিশ করুন। তারপর মোজা পরে ঘুমান।
ঠোঁট: রাতে লিপ বাম ব্যবহারের আগে এক ফোঁটা মিশ্রিত গ্লিসারিন (গোলাপ জলের সাথে মেশানো) ঠোঁটে আলতো করে লাগান।
যেভাবে গ্লিসারিন করলে ক্ষতি হতে পারে
গ্লিসারিন ব্যবহার করার সময় অনেকেই একটি মারাত্মক ভুল করেন, যা ত্বকের উপকারের বদলে ক্ষতি করতে পারে।
১০০% খাঁটি গ্লিসারিন সরাসরি ব্যবহার
কখনোই সরাসরি এবং পাতলা না করে (Undiluted) খাঁটি গ্লিসারিন ত্বকে লাগাবেন না।
বিপদ: গ্লিসারিন একটি শক্তিশালী হিউমেক্ট্যান্ট। যখন এটি সরাসরি ত্বকে ব্যবহার করা হয়, বিশেষ করে শুষ্ক আবহাওয়ায়, তখন এটি ত্বককে আরও শুষ্ক করে দিতে পারে। কারণ এটি বাতাস থেকে আর্দ্রতা না পেয়ে ত্বকের গভীর স্তর থেকে জল টেনে এনে ত্বকের বাইরের স্তরে নিয়ে আসে। এই জলীয় অংশ দ্রুত বাষ্পীভূত হলে ত্বক উল্টো আরও ডিহাইড্রেটেড হয়ে যায়।
করণীয়: সব সময় এটিকে জল বা গোলাপ জলের মতো উপাদানের সাথে ১:৩ বা ১:৪ অনুপাতে মিশিয়ে ব্যবহার করুন।
অতিরিক্ত পরিমাণে ব্যবহার
গ্লিসারিন খুব অল্প পরিমাণেই যথেষ্ট।
বিপদ: প্রয়োজনের অতিরিক্ত গ্লিসারিন ব্যবহার করলে ত্বক অতিরিক্ত চিটচিটে বা আঠালো হয়ে যাবে। এর ফলে বাতাস থেকে ধুলো, ময়লা এবং দূষণ সহজেই ত্বকে আটকে যাবে, যা পরে ব্রণ বা অ্যালার্জির কারণ হতে পারে।
করণীয়: প্রতিটি ব্যবহারের জন্য ২ থেকে ৫ ফোঁটার বেশি নয়।
জরুরি সতর্কতা: নিরাপদ ত্বক পরিচর্যার জন্য
গ্লিসারিন ব্যবহারে সতর্কতা
প্যাচ টেস্ট (Patch Test) আবশ্যক
প্রথমবার গ্লিসারিন ব্যবহার করার আগে অবশ্যই ত্বকের একটি ছোট অংশে পরীক্ষা করে নিন।
পদ্ধতি: কানের পেছনে বা হাতের কনুইয়ের ভেতরের দিকে অল্প পরিমাণে মিশ্রিত গ্লিসারিন লাগিয়ে ২৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করুন। যদি কোনো প্রকার জ্বালা, লালচে ভাব বা অ্যালার্জি দেখা না দেয়, তবেই এটি ব্যবহার করুন।
রাতের রুটিনে গুরুত্ব দিন
গ্লিসারিন ব্যবহারের জন্য রাত হলো সবচেয়ে উপযুক্ত সময়।
কারণ: রাতে ত্বক বিশ্রাম নেয় এবং এটি পুরোপুরি শোষিত হওয়ার সুযোগ পায়। দিনের বেলায় বাইরে বের হওয়ার আগে এটি ব্যবহার করলে ত্বক সামান্য আঠালো থাকার কারণে ধুলো বা ময়লা আকর্ষণ করতে পারে।
এর পরে সানস্ক্রিন ভুলবেন না
দিনের বেলায় গ্লিসারিন ব্যবহার করলে ত্বক চিটচিটে হতে পারে, যা ধুলো আকর্ষণ করে।
করণীয়: দিনের রুটিনে গ্লিসারিন-যুক্ত ময়েশ্চারাইজার ব্যবহারের পর অবশ্যই একটি উপযুক্ত সানস্ক্রিন ব্যবহার করুন।
Comments