প্রতিটি মায়ের কাছেই তার সন্তানের সুস্থতা সবার আগে। আর শিশুর সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা, মেধার বিকাশ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির মূল ভিত্তি হলো ‘নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার’। কিন্তু বর্তমান সময়ে ভেজাল খাদ্য, জাঙ্ক ফুডের সহজলভ্যতা এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে শিশুর খাবার নিয়ে মায়েরা প্রায়ই দুশ্চিন্তায় থাকেন।
শিশুর জন্য কোনটি নিরাপদ খাবার এবং তা নিশ্চিত করতে একজন মায়ের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? চলুন জেনে নেওয়া যাক।
বয়সভিত্তিক খাবারের তালিকা তৈরি
সব বয়সের শিশুর জন্য সব খাবার নিরাপদ নয়। বয়স অনুযায়ী খাবারের ধরণ বদলাতে হয়।
-
০ থেকে ৬ মাস: এই সময়ে মায়ের বুকের দুধই শিশুর একমাত্র এবং সবচেয়ে নিরাপদ খাবার। এমনকি এক ফোঁটা পানিরও প্রয়োজন নেই। মায়ের দুধ শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়।
-
৬ মাসের পর: ৬ মাস পূর্ণ হলে মায়ের দুধের পাশাপাশি শিশুকে বাড়তি খাবার বা ‘উইনিং ফুড’ দেওয়া শুরু করতে হবে। ঘরের তৈরি সুজি, খিচুড়ি, বা ফলের পিউরি দিয়ে শুরু করাটা সবচেয়ে নিরাপদ।
হাইজিন বা পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
শিশুর পেটের পীড়া বা ডায়রিয়ার মূল কারণ অপরিচ্ছন্ন খাবার। মা হিসেবে আপনাকে কিছু বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে:
-
হাত ধোয়া: খাবার তৈরি এবং শিশুকে খাওয়ানোর আগে অবশ্যই সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুয়ে নিন।
-
পাত্রের পরিচ্ছন্নতা: শিশুর খাবার বাটি, চামচ এবং রান্নার পাত্র ভালো করে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত (প্রয়োজনে ফুটন্ত গরম পানিতে ধুয়ে) করে নিতে হবে।
-
রান্নার সতর্কতা: শাক-সবজি ও ফলমূল কাটার আগে ভালো করে ধুয়ে নিন। খাবার সবসময় ঢেকে রাখুন যাতে মাছি বা ধুলোবালি না পড়ে।
বাইরের প্যাকেটজাত খাবারকে ‘না’ বলুন
টিভি বিজ্ঞাপন বা রঙিন মোড়ক দেখে শিশুরা চিপস, জুস, চকলেট বা প্রসেসড ফুডের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এসব খাবারে অতিরিক্ত লবণ, চিনি এবং প্রিজারভেটিভ থাকে, যা শিশুর কিডনি ও লিভারের জন্য ক্ষতিকর।
-
মায়ের করণীয়: শিশুকে বাইরের খাবারের বদলে ঘরে তৈরি নাস্তা দিন। যেমন—আলুর চিপস না দিয়ে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বানিয়ে দিন, কেনা জুসের বদলে ফলের রস বা লাচ্ছি তৈরি করে দিন।
সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করা
নিরাপদ খাবার মানে শুধু জীবাণুমুক্ত খাবার নয়, এটি হতে হবে পুষ্টিগুণে ভরপুর। শিশুর খাবারে শর্করা, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন ও মিনারেলের সঠিক ভারসাম্য থাকতে হবে।
-
প্রতিদিনের খাবারে রঙিন শাক-সবজি, মাছ, মাংস, ডাল, ডিম এবং দুধ রাখার চেষ্টা করুন।
-
মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য ওমেগা-৩ যুক্ত খাবার (যেমন—সামুদ্রিক মাছ, আখরোট) এবং হাড়ের জন্য ক্যালসিয়াম জরুরি।
চিনি ও লবণ ব্যবহারে সতর্কতা
এক বছরের কম বয়সী শিশুর খাবারে গরুর দুধ, চিনি এবং লবণ দেওয়া থেকে বিরত থাকুন। লবণের সোডিয়াম শিশুর কচি কিডনির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। আর চিনি দাঁত ক্ষয় ও স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ায়। ফলের প্রাকৃতিক মিষ্টিই শিশুর জন্য যথেষ্ট।
জোর করে খাওয়ানো যাবে না
অনেক মা শিশু খেতে না চাইলে জোর করে খাওয়ান। এতে খাবারের প্রতি শিশুর অনীহা তৈরি হয় এবং বমির ঝুঁকি থাকে।
-
টিপস: শিশু খেতে না চাইলে কিছুক্ষণ বিরতি দিন। খাবারের স্বাদ ও ধরণ পরিবর্তন করুন। খাবারকে আকর্ষণীয়ভাবে পরিবেশন করুন।
পানি পানে সতর্কতা
শিশুর জন্য বিশুদ্ধ পানি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। পানি ফুটিয়ে ঠাণ্ডা করে পান করতে দিন। রাস্তার ধারের শরবত বা খোলা পানি খাওয়ানো থেকে শিশুকে সম্পূর্ণ বিরত রাখুন।
শিশুর খাদ্যাভ্যাস একদিনে গড়ে ওঠে না। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। মা হিসেবে আপনার একটু সচেতনতা, ধৈর্য এবং সৃজনশীলতা শিশুকে দিতে পারে একটি সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ। মনে রাখবেন, আজকের নিরাপদ খাবারই আগামী দিনের সুস্থ প্রজন্মের নিশ্চয়তা।
Comments