একদিকে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদির শাহাদাতে শোক ও ক্ষোভে উত্তাল রাজপথ, অন্যদিকে সেই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের দুই শীর্ষ সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম আলো’ ও ‘দ্য ডেইলি স্টার’ কার্যালয়ে চালানো হয়েছে নজিরবিহীন তাণ্ডব। বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে শুরু হওয়া এই হামলায় ভাঙচুর ও লুটপাটের পর আগুন দেওয়া হয় ভবন দুটিতে। এতে প্রাণ বাঁচাতে ভবনের ছাদে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন সংবাদকর্মীরা। ভয়াবহ এই হামলার পর শুক্রবার পত্রিকা দুটি তাদের মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশ করতে পারেনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে শাহবাগ থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে একদল লোক কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়। তারা ওসমান হাদি হত্যার বিচার ও ভারতবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে তারা প্রথম আলোর চার তলা ভবনের নিচতলার সাটার ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। হামলাকারীরা প্রথমে প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রথমা’র কার্যালয়ে ভাঙচুর চালায়। এরপর পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার হিসাব বিভাগ, বিজ্ঞাপন ও বিপণন বিভাগ এবং চতুর্থ তলায় ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’র কার্যালয়ে লুটপাট ও ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়।
প্রথম আলোতে তাণ্ডব চালানোর পর হামলাকারীরা পাশের দ্য ডেইলি স্টার কার্যালয়ে চড়াও হয়। প্রথমে ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও পরে প্রধান ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে শত শত মানুষ। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে ভবনের ভেতরে থাকা অন্তত ৩০ জন সংবাদকর্মী ও অফিসকর্মী ভবনের ছাদে আশ্রয় নিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেন। হামলাকারীরা নিচতলার কার লিফটসহ আসবাবপত্র ভেঙে চুরমার করে দেয় এবং নিচতলায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই আগুন দ্রুত দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের ধোঁয়ায় ছাদে আটকা পড়া সংবাদকর্মীরা শ্বাসকষ্টে ভুগতে থাকেন। প্রায় চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর ফায়ার সার্ভিস ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় ভোর ৫টার দিকে তাঁদের উদ্ধার করা হয়।
হামলার সময় আটকে পড়া ডেইলি স্টার কর্মীদের খোঁজ নিতে এসে বিক্ষোভকারীদের হাতে লাঞ্ছিত হন ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ এজ’ সম্পাদক ও সম্পাদক পরিষদের সভাপতি নূরুল কবীর।
ঘটনার পরদিন শুক্রবার প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এবং দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সরকারপ্রধানের দপ্তর থেকে জানানো হয়, প্রতিষ্ঠান দুটির এই দুঃসময়ে সরকার তাদের পাশে আছে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ওপর এই হামলা স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর হামলার শামিল। এই ঘটনা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে এক বিরাট বাধা।”
এর আগে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম নিজের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে দুঃখ প্রকাশ করে লেখেন, “একজন সাবেক সাংবাদিক হিসেবে আমি সরি।”
শুক্রবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, প্রথম আলোর চার তলা ভবনের কোনো আসবাবই অক্ষত নেই। তৃতীয় তলার হিসাব বিভাগের লকার ভেঙে নগদ অর্থ লুটের অভিযোগ উঠেছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকির কার্যালয়ের দরজা ভেঙে টেলিভিশন ও কম্পিউটারসহ মূল্যবান সরঞ্জাম লুট করা হয়েছে।
অন্যদিকে ডেইলি স্টার ভবনের পাঁচ তলা পর্যন্ত লুটপাট চালানো হয়েছে। অফিসের কম্পিউটার, ক্যামেরা লেন্স, এমনকি পানি পানের মগ পর্যন্ত লুট হয়ে গেছে। হামলাকারীরা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িকেও শুরুতে ঘটনাস্থলে যেতে বাধা দেয় বলে অভিযোগ উঠেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, উদ্ধার অভিযানে আরও দেরি হলে ধোঁয়ায় ছাদে বড় ধরনের প্রাণহানির আশঙ্কা ছিল।
শুক্রবার সকালে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ের সামনে পুলিশি পাহারা জোরদার করা হয়েছে। সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থল থেকে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলার ঠিক আগেই পুলিশ মোতায়েন করা হলেও তারা জনরোষের সামনে হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়।
বাংলাদেশে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ওপর এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ১০ দেশের জোট ‘মিডিয়া ফ্রিডম কোয়ালিশন’। এক যৌথ বিবৃতিতে তারা জানায়, সংবাদকর্মীদের ওপর এই সহিংসতা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য এবং এটি মুক্ত সমাজের ওপর সরাসরি হুমকি।
বর্তমানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও কারওয়ান বাজার এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উগ্র গোষ্ঠীর যে কোনো সহিংসতা রুখতে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।




Comments