বিশ্বায়ন আর তথ্যপ্রযুক্তির দুর্বৃত্তায়ন চলছে সারাবিশ্বে। ভোগবাদীর বিলাসিতায় মানুষ ছুটে চলছে অনবরত। অর্থ, বিত্ত আর সামাজিক স্ট্যাটাসের পর্বত চ‚ড়ায় উঠতে হবে যে করেই হোক। মানুষের মানসিকতায় তাই ভর করছে শকুনির বুদ্ধি। অসুস্থতা ঢুকে গেছে বেশির ভাগ মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর তাইতো নান্দনিক ভাবনার কোনো অবকাশ নেই। সত্য-সুন্দরের প্রেরণা নাই বলেই মানুষ ইদানীং আর বই পড়ে না।
বই কিনে না কিংবা অন্য কাউকেও বই আর উপহার দেয় না। যাদের সত্যিকারের বই পড়ার মানসিকতা আছে, যাদের ভাবনা এখনো রোগাক্রান্ত নয়, যারা অনেক কিছু সম্পর্কে জানতে চায়, নিজেদেরকে নান্দনিক ভাবধারার সাথে সংপৃক্ত করতে চায় দুর্ভাগ্যবশতঃ তাদের বই কেনার সামর্থ্য নেই। সত্যিই তাই। বাংলাদেশের অনেকেরই বইমেলায় গিয়ে বই কিনে পড়ার ইচ্ছে থাকলেও বই কেনার সামর্থ্য থাকে না। এরা অবশ্য ভোগবাদী সাম্রাজ্যবাদের কালো থাবার বেশ বাইরে যাদের স্বপ্ন খুব সীমিত, বেঁচে থাকতে চায় সম্মানের সাথে। এরা বাস করে নিম্ন মধ্যবিত্তের প্রান্তিকে।
এই একুশের বইমেলায় আমার তিনটি বই বেরিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দেখে কোনো একজন লিখেছিলেন- দস্যার, বইগুলো পড়ার খুব ইচ্ছে করে কিন্তু বইমেলায় গিয়ে বইগুলো সংগ্রহ করার সামর্থ্য নাই। সত্যিই কথাগুলো এই সময়ের বাস্তবতা। যাদের বই কেনার ক্ষমতা আছে তাদের বই পড়ার রুচি নেই, তাদের জানার আগ্রহ নেই কারণ তাদের মনের নান্দনিক চেতনারা মরে গেছে। উল্টো রথে চলছে পৃথিবীটা আর পৃথিবীর মানুষগুলো। তাইতো সমাজের অনেকে ভেবে অবাক হন কেন আমাদের চারদিকে জ্ঞানের এত অভাব। রুচির সংঘাতিক দুরবস্থা। কি সমাজে, অর্থনীতিতে কিংবা সমাজনীতিতে চলছে প্রজ্ঞাহীন মানুষের সরব ডামাডোল। তাইতো
দুর্বৃত্তায়নে ছেয়ে গেছে পুরো সমাজ। বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না- এই উক্তিটি করেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। তবে বই কিনে দেউলিয়া না হতে চাইলে বইয়ের যতœ নিতে হবে, বইটিকে মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে, শিখতে হবে এবং শেখার জ্ঞানকে যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে হবে। আমার এক বন্ধু কবি, প্রাবন্ধিক ও স্বনামধন্য সাংবাদিক কথা প্রসঙ্গে বললেন বই কিনেই তিনি দেউলিয়াত্বের প্রান্তে কারণ ইদানীং তিনি বাকিতেও বই কেনা শুরু করেছেন। বই জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষক, আনন্দের খোরাক, সৎ চিন্তার মহৌষধি এবং বর্তমান আর অতীতের মধ্যে মেলবন্ধনের সিঁড়ি। জ্ঞানের প্রসারে বইয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই একবিংশ শতাব্দীর নানা হট্টগোলের মধ্যে সুন্দরভাবে পথ চলায় বই পড়ার বিকল্প আর কিছু নেই।
জ্ঞানার্জনের চাবিকাঠি হলো ভালো বই। আর জ্ঞানার্জন হলো আড়ষ্ঠতা আর পংকিলতা থেকে মুক্তির ঠিকানা, মানুষের সত্যিকারের মুক্তির দিশারী। তাই আমাদের মনে রাখতে হবে মানুষের বেঁচে থাকার নির্ভরতা অমলীন আনন্দ আর জ্ঞানের আধার লুকিয়ে আছে বইয়ের পাতায় পাতায়, শব্দমালায় আর অক্ষরে অক্ষরে। যারা এই আনন্দের সাথে সংপৃক্ত হতে পারে না শুধু সুস্থ রুচির অভাবে তারা সমাজের দুর্ভাগ্যজনদের কাতারেই বাস করে। বই তাদের প্রিয় জিনিসগুলোর মধ্যে কখনো স্থান পায় না। পারস্য কবি ওমর খৈয়াম এই জ্ঞানের আর আনন্দের আধার বইকে বেছে নিয়েছিলেন স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম উপকরণ হিসেবে। ষাটের দশকের শুরুর দিকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন প্রয়াত কথাসাহিত্যিক সরদার জয়েন উদ্দীন।
১৯৬৫ সালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরির নীচতলায় আয়োজন করা হয় শিশু গ্রন্থমেলার। অনেকের মতে সেটাই সম্ভবতঃ ছিল বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে প্রথম বইমেলা। ১৯৭০ সালে নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে তিনি আরো একটি গ্রন্থমেলার আয়োজন করেছিলেন। মানুষকে বই পাঠে উৎসাহিত করার জন্য তিনি এক অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। মেলার প্রাঙ্গণে একটি গরু বেঁধে তার গায়ে লিখে দেন আমি বই পড়ি না। টলস্টয়ের মতে মানুষের সবচেয়ে তিনটি মূল্যবান সম্পদ হলো বই, বই, আর বই। তবে আজকের পৃথিবীটা একটু অন্যরকম। তাই এই পৃথিবীর মানুষগুলোও ভিন্ন। তাদের মানষিকতায় খরা এসেছে। শুধু দর্শনার্থীদের ব্যাপারেই বলছি না। যারা বইমেলায় যায় তাদের বেলায়ও যেমন ব্যাপারটা সত্য, যারা কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করেন তাদের ব্যাপারেও পুরো সত্য। তার মধ্যে সম্মানিত প্রকাশকগণ বাদ যাবেন কেন? বাংলাদেশের একুশের বইমেলা তো প্রকাশকদের রুজি-রোজগারের অভয়ারণ্য, ব্যবসা-বাণিজ্যের রম রমা পসরা সাজিয়ে বসার উপযুক্ত জায়গা। এই এক মাসে যে বাণিজ্য করা যাবে বাকি এগার মাস কুম্ভকর্নের বাতাস লাগলেও কোনো অসুবিধা নেই। বইমেলাকে ঘিরে চলে রম রমা পরিস্থিতি, উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনা সকলের মধ্যে।
লেখকদের জন্য এ যেন এক সুবর্ণ সুযোগ। নিজেদের সৃজনশীল কাজের সাথে পাঠকদের পরিচয় কিংবা বিস্তৃত পরিসরে সংযোগ স্থাপনের জন্য বইমেলা হয়ে উঠে গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম। শুধুই কি তাই? এখানে প্রায়ই প্রকাশক, এজেন্ট এবং অন্যান্য শিল্প পেশাদারদের আকর্ষণ করে যা লেখকদের জন্য সংযোগ স্থাপনের একটা বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়। তাছাড়া বিশেষ করে নবীন লেখকরা প্রকাশনা এবং সহযোগিতার জন্য সম্ভাব্য উপায়গুলো অন্বেষণ করার সুযোগ পায়। বইমেলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে, লেখকরা তাদের কাজের জন্য দৃশ্যমানতা বাড়াতে পারেন, তাদের পাঠক সম্প্রসারণ করতে পারেন এবং সাহিত্যিক সম্প্রদায়ের মধ্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন যা অবশ্যই একজন লেখকের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজন। প্রতিবছর বইমেলায় কয়েক হাজার বই আসে।
২০২২ সালে নতুন বইয়ের সংখ্যা ছিল প্রায় চার হাজার। গত বছর এ সংখ্যাটা ছিল আরো বেশি। এক কবি বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এবার কতগুলো নতুন বই মেলায় আসবে। ব্যঙ্গ করে উত্তর দিয়েছিলেন কয়েক হাজার লেখকের প্রায় আট হাজারের উপর। সঠিক তথ্যটা কখনো জানা যাবে কিনা জানি না। তবে লেখকরা খুব ব্যস্ত। টিভি ইন্টারভিউ, মোড়ক উন্মোচন আর সোশ্যাল মিডিয়ায় নানাভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে। একটা দেশে সৃজনশীলতার চর্চা হবে, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হবে, আমাদের ভাবনায়, মননে, চেতনায় ঋজুতা আসবে তা যে কোনো সমাজের জন্য অবশ্যই কাম্য। আমরা সকলেই তার প্রশংসা করি। কিন্তু আদতে কি দেখছি? পুরো উল্টোটা। এখানে কবির অভাব নেই, শুধু কবিতার অভাব, এখানে লেখকের অভাব নেই, শুধু ভালো লেখার অভাব, এখানে বইয়ের অভাব নেই, শুধু ভালো বইয়ের অভাব। তাই বই কেনা লোকের অভাব। প্রতিদিন নাকি হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে উপচিয়ে পড়ছে বইমেলার বাংলা একাডেমি এবং সোহরাওয়ার্দী চত্বর।
শুক্রবার নাকি মানুষের ঢল নামে। তাহলে তো অবশ্যই এটা একটা আশাব্যঞ্জক ব্যাপার। বইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। বই পড়ার জন্য আমাদের শিশু-কিশোরদের অনুপ্রাণিত করা হচ্ছে। উৎসবমুখর পরিবেশে মানুষ জ্ঞান অন্বেষণে নিবিড়ভাবে বইয়ের সাথে সম্পৃক্ত করছে। এতো সত্যিই খুশের খবর। কিন্তু সেই একই কবি বন্ধুর মুখে যা শুনলাম তা সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক। উনার কথায়Ñ বেশির ভাগ মানুষ বইমেলায় আসে বই কেনার জন্য নয়। আসে শুধু সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার জন্য। খাওয়া-দাওয়া আর হইচই করে ঘোরাফেরা করে আবার ঘরে ফিরে যায়। আর যারা বই কেনার আগ্রহ নিয়ে আসেন ভালো বই না পেয়ে প্রায় সময়ই ভ্রু কুঁচকে আর দীর্ঘশ্বাসে নিজের বিরক্ত ভাবটাকে চেপে রেখে নিরাশ হয়ে দুই একটি বই কিনে নিয়ে যায়। আমরা সকলেই ব্যতিব্যস্ত আমাদের দেহটার ভরণ-পোষণে। যত পারো খেয়ে নাও। একদিকে মজা করে খেতে যেতে দেহের ভেতর গ্যাস জমা করে বুকের উপর হাত চেপে ধরো শক্ত করে আর অন্যদিকে গ্যাস কমানোর ট্যাবলেট পেটে ভরতে থাকো। তাইতো চলছে সারা বাংলাদেশে। কিন্তু মনটাকে সুস্থ রাখার জন্য আমাদের কারো কোনো আগ্রহ নেই। মন যেন পরবাসী। অথচ মনটাকে সুস্থ রাখা আমাদের সর্বাগ্রে জরুরি। মনটা ভালো থাকলে আমাদের দেহটাও ভালো থাকবে। আর মনকে সুস্থ রাখার একমাত্র উপায় বই পড়া। বই হলো মনের পুষ্টি, উত্তম খোরাক।
দেহ ও মনকে ভালো রাখার জন্য, অন্যের সাথে ভালোভাবে সামাজিক যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্য, সুস্থ মানষিকতার উৎকর্ষের জন্য আনন্দ ও আগ্রহের সাথে আমাদের সকলেরই উচিত ভালো বই পড়া। বই পড়া আমাদের এবং অন্যদের সম্পর্কে বোঝাপড়া বৃদ্ধি-সহ সহানুভ‚তি, আত্মসম্মান এবং ইতিবাচক মনোভাব বৃদ্ধি করতে পারে। ভালো বই হতে পারে আমাদের উত্তম বন্ধু এবং বিনয়ী হওয়ার উপযুক্ত মাধ্যম। ঢাকা একুশে বইমেলা শুধু বাংলাদেশেই নয়, বৃহত্তর দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলেও সাহিত্য ও সাংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে বিশেষ ভূমিকা রেখে আসছে। গত পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে বাংলা একাডেমির বইমেলার প্রাঙ্গণটি আলোকবর্তিকা হয়ে বাংলার মানুষদের বই পড়ায় উৎসাহিত করে জ্ঞান অন্বেষণের পথ দেখিয়ে আসছে। ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর একুশের বইমেলা হয়ে উঠেছে বাংলার মানুষের আত্ম-পরিচয়ের তিলক। চলার পথের সারথী।
ভাষা আন্দোলনে যারা প্রাণ দিয়েছিলেন তাদেরকে সম্মান জানানোর জন্য, সেই দিনের স্মৃতিকে চির অ¤øান করে রাখার জন্যই ফেব্রæয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির সামনে আয়োজিত বইমেলার নামকরণ করা হয় একুশের বইমেলা। স্বাধীনতার পর প্রথম বইমেলার আয়োজন করা হয় ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রæয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণের বটতলায় আয়োজিত প্রথম বইমেলায় মাত্র ৩২টি বই ছিল। এই বইগুলো প্রকাশ করে চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত বাংলা সাহিত্য পরিষদ। ১৯৭৮ সাল থেকে বইমেলা শুরু হয় বাংলা একাডেমিতে। বাংলা একাডেমি আয়োজিত এই মেলার লক্ষ্য ছিল বাংলা সাহিত্যের প্রচার এবং জনসাধারণের মধ্যে পাঠের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। প্রাথমিকভাবে একটি পরিমিত স্কেলে অনুষ্ঠিত, মেলাটি ধীরে ধীরে আকার এবং পরিধিতে প্রসারিত হয়, যা
সারাদেশের প্রকাশক, লেখক এবং পাঠকদের আকর্ষণ করে। বছরের পর বছর ধরে, ঢাকা একুশে বইমেলা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে প্রাণবন্ত সাহিত্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মেলায় সাহিত্য সেমিনার, কবিতা পাঠ, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং শিল্প প্রদর্শনী-সহ নানা কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের জনসাধারণের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য একটি অনবদ্য মেলা। অমর একুশে বইমেলা ভাষা আন্দোলনের চিরন্তন উত্তরাধিকার এবং বাঙালি সংস্কৃতির মেরুদণ্ড হয়ে অগণিত পাঠক, লেখক এবং প্রকাশকদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে। একুশের চেতনা এবং সমাজকে ঐক্যবদ্ধ, শিক্ষিত এবং সৃজনশীলতায় উজ্জীবিত করতে সাহিত্যের নিরন্তর শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাদের সবাইকে বই কেনা এবং বই পড়ায় মনোনিবেশ করতে হবে।
লেখক: শিক্ষক, গবেষক এবং কলামিস্ট
মানবকণ্ঠ/এআই
Comments