৫ আগস্ট ২০২৪। এক অবিস্মরণীয় মহাবিপ্লবের সাক্ষী হলো বাংলাদেশ। অবসান হলো অনির্বাচিত-অগণতান্ত্রিক আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকারের দীর্ঘ দুঃশাসনের। ছাত্র-জনতার প্রাণোৎসর্গের বিনিময়ে অর্জিত হলো এক মহাবিজয়। গণহত্যা চালিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে মসনদে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করছিল আওয়ামী লীগ। প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে লেলিয়ে দিয়েছিল ছাত্রলীগকে। মূলত এরপর থেকেই শুরু হয় তাদের সীমাহীন সন্ত্রাস। দলীয় নেতাকর্মীরা প্রকাশ্য আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে গুলিবর্ষণ করে নিরীহ ছাত্র-জনতার উদ্দেশ্যে। বসে ছিল না রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীও।
এখানেই একটি প্রশ্ন তৈরি হয়- জনগণের অর্থে পরিচালিত পুলিশ বাহিনী কি এভাবে নির্বিচার গণহত্যায় অংশ নিতে পারে? আসলে যেটি হয়েছে তা হলো, বিগত পনেরো বছরে দলীয় বিবেচনায় ব্যাপকহারে লোকবল নিয়োগ দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সংস্থায়। ফলে যার গায়ে পুলিশের পোশাক আছে, প্রশিক্ষণ আছে, অস্ত্র আছে আর যার রাজনৈতিক পরিচয় ছাত্রলীগ নেতা, তিনি তার দলের সমর্থনে থেকে আন্দোলন দমানোর কাজে কতটা ভয়ঙ্কর ভূমিকা রাখতে পারেন তা আমরা সাম্প্রতিক দিনগুলোর ‘জুলাই গণহত্যা’য় প্রত্যক্ষ করলাম। তবু সবাই-ই যে এরকম ভূমিকায় ছিলেন, তা নয়; বরং অনেকেই ছিলেন সত্যিকারের ‘জনগণের বন্ধু’।
সরকারি চাকরিতে কোটা বৈষম্য দূর করে একটি যৌক্তিক সংস্কারের দাবি নিয়ে সম্পূর্ণ অহিংসভাবেই শুরু হয়েছিল ছাত্রআন্দোলন। দাবিটি প্রথমেই মেনে নিতে পারতো সরকার। কিন্তু কালক্ষেপণ করা, ছাত্রলীগ লেলিয়ে দেয়া এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে ছাত্রদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ সম্বোধন করে কটুক্তি আগুনে ঘি ঢালার কাজটি করে। রাতেই বিভিন্ন হল থেকে রাস্তায় নেমে আসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এরপর ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের প্রকাশ্য গুলিতে শাহাদাতের ঘটনাটি আপামর জনতার হৃদয়ে আঘাত হানে।
সারাদেশে ছয়জন শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে ছাত্ররা। তারা দেশের সর্বস্তরের জনগণকে রাস্তায় নেমে তাদের পাশে দাঁড়াবার আহবান জানায়। জনতাও নেমে আসেন রাজপথে। সরকারের দলীয় সন্ত্রাসীদের হাতে এবং পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে হু-হু করে। সারাদেশ অগ্নিগর্ভ হয়ে ওয়ে ওঠে। এ সময় সরকার ইন্টারনেট বন্ধ ঘোষণা করে কারফিউ জারি করলেও আন্দোলন চলতে থাকে। গণমাধ্যমকে খবর প্রচারে বিধিনিষেধ দিলেও এ সময়ে বিশ্বমিডিয়ায় প্রচার হতে থাকে বাংলাদেশের খবর।
কারফিউর পরে ধীরে ধীরে ইন্টারনেট খুলে দিয়ে সরকারপ্রধান যান বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি দেখতে। এ সময় আহত-নিহতদের জন্য কোনোপ্রকার শোক ও সমবেদনা না জানিয়ে স্থাপনার সামনে গিয়ে কাঁদতে দেখা যায় তাকে। কারফিউ শিথিল হলেও ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি অব্যাহত থাকে। ছয় সমন্বয়ককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ডিবি কার্যালয়ে। সেখান থেকে বিবৃতি দিয়ে কর্মসূচি প্রত্যাহারে বাধ্য করা হয় তাদের। কিন্তু এ বিবৃতি দিতে যে তাদের বাধ্য করা হয়েছে তা বুঝতে বাকি থাকে না দেশবাসীর।
আন্দোলনে সহিংসতার জন্য প্রথম থেকেই বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে আসে সরকার। গত ২৯ জুলাই সোমবার জরুরি ভিত্তিতে ১৪ দলের মিটিং ডেকে আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও সহিংসতায় ইন্ধন জোগানোর অভিযোগ এনে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পরে ১ আগস্ট নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় জামায়াত-শিবিরকে। এর বিপক্ষে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দেয় বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান তার বিবৃতিতে বলেন- সরকার ছাত্রজনতার ওপর গণহত্যা চালিয়ে তা ঢাকার জন্যই তাদের দলকে নিষিদ্ধ করেছে। একটি রাজনৈতিক দল কখনও আরেকটি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে সারাদেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হয়। আন্দোলনে নেপথ্যে জামায়াত-বিএনপি জড়িত থাকার অভিযোগ এনে সরকার একতরফা দমন-পীড়ন চালাতে থাকে। সর্বশেষ গত ৪ আগস্ট সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচির প্রথম দিনেই সারাদেশে ১৮ জেলায় ব্যাপক সন্ত্রাস চালায় সরকার দল আওয়ামী লীগ এবং পুলিশ বাহিনী। সংবাদমাধ্যমে আসা খবরে প্রতি মুহূর্তেই বাড়তে থাকে নিহতের সংখ্যা, যা সর্বশেষ ১১৪-তে গিয়ে দাঁড়ায়। পত্রিকায় প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী চার শতাধিক ছাত্র-জনতার শাহাদাত, অন্তত সাত হাজার মানুষের আহত-পঙ্গুত্ববরণ এবং প্রায় ৮ শতাধিক গণমামলায় ১২ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার হতে হয়।
এ চরম নির্যাতন-নিষ্পেষণের প্রেক্ষাপটে ছাত্রদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন এদেশের সাধারণ মানুষ, কিশোর-কিশোরী, ছাত্র-শিক্ষক, কবি-শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, শ্রমিক জনতা ও সর্বস্তরের পেশাজীবীরা। মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ডান-বামসহ সমস্ত মতামতের রাজনীতি। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অহিংস কর্মসূচির প্রথম দিন থেকে শুরু করে শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফায় রূপ নেয়া পর্যন্ত যে ৩৬ দিন, তার মূল প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে বিগত ১৫ বছরের শ্বাসরুদ্ধকর স্বৈরাচারী দুঃশাসনকালে। তার শাসনকালে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলোর নেতাদের নামে হাজার হাজার মামলা দিয়ে লাখো জনতাকে গণহারে গ্রেপ্তার করা হয়। যেকোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে রাস্তায় নামলেই কঠোরভাবে দমন-পীড়ন করা হয় নেতাকর্মীদের। সরকারবিরোধী যেকোনো আন্দোলন দমন করতে সরাসরি-নির্বিচার গুলির ব্যবহার করা হয়।
গুম-খুন, ক্রসফায়ার ও গণগ্রেপ্তার ছিলো শেখ হাসিনার শাসনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ছয় শতাধিক মানুষকে গুম করা হয়, যাদের ১৭০ জনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি আজও অবধি। এ সময়ে ক্রসফায়ারের অভিযোগে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আসে র্যাবের ওপরও। রাষ্ট্রীয় সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে দলীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দলমত নির্বিশেষে গণমানুষের জন্য উন্মুক্ত সেবা গ্রহণের পথ সংকুচিত করা হয়। আইনের শাসন হয় ভূলুণ্ঠিত, অবরুদ্ধ করা হয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও। প্রবল মূল্যস্ফীতিতে নিম্নআয়ের সাধারণ মানুষের জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। এ অবস্থায়ও ভোটাধিকারবঞ্চিত মানুষের কাছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও আইন করে সংকুচিত করা হয়। ফলে ১৫ বছর ধরে যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, তারই বিস্ফোরণে জনস্রোতে ভেসে যেতে হয় শেখ হাসিনাকে।
বাংলাদেশ এমন এক মহাবিপ্লবের সাক্ষী হয়ে রইল, যার সূচনা করেছিল এদেশের তরুণ শিক্ষার্থীরা। তারা তাদের ঐক্যে, সাহসে ও প্রজ্ঞায় এই আন্দোলনকে সাফল্যের চূড়ায় নিয়ে গিয়ে পৃথিবীর সামনে এক অনন্য নজীর স্থাপন করেছে। এখন সময় দেশকে গড়ার, এগিয়ে নেবার। দেশের সম্পদ রক্ষা করতে হবে, সেইসঙ্গে দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের মতো অপকর্মে যেন কেউ আর জড়িত হতে না পারে সেদিকেও নজর দিতে হবে। বিচারের আওতায় আনতে হবে সমস্ত দুষ্কৃতকারীদের। কোথাও যেন কেউ হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে জড়াতে না পারে সেদিকেও নজর রাখতে হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা বিধানে জোর দিতে হবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ দেশের শান্তিপ্রিয় জনতাকে। ইতোমধ্যেই বিএনপি-জামায়াসহ সব রাজনৈতিক দলের তরফে সবাইকে সংঘাত-ভাঙচুরসহ সকল অরাজকতা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।
দেশের জাতীয় ঐক্যে যেরকম ফাটল ধরানো হয়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে এসে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে ভালোবাসতে হবে এ দেশকে, এগিয়ে নিতে হবে পুরোদমে। স্বৈরশাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে মানুষের সুন্দর জীবনের স্বপ্ন হয়েছে আকাশচুম্বী। এই স্বপ্নকে এবার সত্যি করতে হবে। শহীদদের পরিবার যেন ন্যায়বিচার পান তা নিশ্চিত করতে হবে। আহত-পঙ্গুত্ববরণকারীদের পাশে এখনই দাঁড়াতে হবে রাষ্ট্রকে। চার শতাধিক দেশপ্রেমিক ছাত্রজনতার শাহাদাতের সিঁড়ি বেয়ে যে বিজয় অর্জিত হলো তাকে সমুন্নত রাখতে হবে।
আমরা খুনি সরকারের পাতানো শোক দিবসকে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, প্রতিবাদ করেছিলাম সবার ফেসবুক প্রোফাইল লাল করে। এখন, এ মহাবিপ্লবের পর, শেখ হাসিনার নির্বিচার গণহত্যায় শাহাদাতবরণকারী তরুণ-তাজাপ্রাণ বীর সন্তানদের স্মরণে শোকে আনত হবার সময় হলো।
মানবকণ্ঠ/এফআই
Comments