Image description

পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার কৃতি সন্তান এবং ভারতীয় উপমহাদেশের একজন নাট্যকার, মঞ্চ অভিনেতা, টিভি নাটক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, পরিচালক এবং কণ্ঠশিল্পী। সঙ্গীত জগতে তাকে বাংলাদেশের ভ‚পেন হাজারিকা বলা হয়।

স্বাধীনতার পরে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলায় রংচক্র নামে একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক সাহিত্য সংগঠন গড়ে তোলেন একঝাঁক তরুণদের নিয়ে। গান, নাটক, সাহিত্যকর্ম ও খেলাধুলার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের বাসযোগ্য সমাজ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন।

সমাজ ও সমাজের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে সাম্য সমৃদ্ধ শোষণ বঞ্চনামুক্ত সমাজের জন্য লড়াইয়ের অকুতোভয় শিল্পযোদ্ধা ছিলেন। অভিনেতা মাসুম আজিজ ২২ অক্টোবর ১৯৫৩ সালে পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার খাগবাড়িয়া গ্রামে একটি উচ্চ শিক্ষিত সামাজিক সাংস্কৃতিক বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা কবি আক্তারুজ্জামান ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। বাবার চাকরির কারণে দেশের নানা অঞ্চলে নানা মানুষের মধ্যে বেড়ে উঠেছেন তিনি। 

মানুষ আজিজ ছোট বেলা গান করতেন। তার ইচ্ছে ছিল তিনি বড় একজন গায়ক হবেন। কিন্তু তিনি হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের একজন বরেণ্য নাট্যকার, অভিনেতা। অভিনয় জগতে অন্যান্য অভিনেতাদের থেকে একটু ভিন্ন ধরনের অভিনয়ের মাধ্যমে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে এসেছেন এবং সাধারণ মানুষের জীবন ভিত্তিক অভিনয় করে সমাজের চিত্র সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে অভিনয় করে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। ১৯৭৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে করেন ‘সোহরাব রোস্তম পালা’। থিয়েটারের এই যাত্রার মাঝেই পরিচয় হয় তার নাট্যগুরু মামুনুর রাশীদের সাথে। মাসুম আজিজ হয়ে ওঠার পেছনে তার অসামান্য অবদান রয়েছে।

মাসুম আজিজের অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক-ইন্সপেক্টর জেনারেল, রাক্ষস-খোক্কস, এই দেশে এই বেশে, আমিনা সুন্দরী, ইঙ্গিত, বিষাদ-সিন্ধু, জলদাস, আপদ এবং ট্রায়াল অব সূর্যসেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আপদ গল্পকে নাট্যরূপ দিয়ে নির্দেশনা দেন। তার রচনা ও নির্দেশনায় ঢাকা পদাতিকের প্রযোজনা ট্রায়াল অব সূর্যসেন। তার রচনা ও নির্দেশনায় ‘থিয়েটার মঞ্চ’ থেকে মঞ্চে আসে ‘কাঠের গড়া’। নাট্যরচনা-আপদ, ট্রায়াল অব সূর্যসেন, মাদারিকা খেল, টেলিফোন ম্যাজিক, কাঠের গড়া।

মাসুম আজিজ ১৯৮৫ সালে টেলিভিশন মাধ্যমে অভিনয় শুরু করেন। তিনি ৪০০-এর অধিক নাটকে অভিনয় করেন। ২০০০ সালে ‘একজন আয়নার লস্কর’ নাটকের জন্য মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার এবং বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। তার নিজের নির্দেশনায় নির্মিত নাটক ‘কদম আলী বয়াতি’র জন্য বাচসাস পুরস্কার পান। এর পরবর্তীতে একাধিকবার বাচসাসসহ আরও অনেক সম্মাননায় তিনি ভূষিত হন। এর মাঝে তিনি বারবার ফিরে গেছেন শিল্পের সেই ধারায়, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল তার শিল্পের যাত্রা। একবার মামুনুর রশীদের সাথে ভারতের আসামে গিয়ে ভুপেন হাজারিকার সরাসরি সান্নিধ্য লাভ করেন এবং ভূপেন হাজারিকার গাওয়া গান গেয়ে ভূপেন হাজারিকার প্রশংসা পেয়েছিলেন। তিনি ভূপেনের গান গেয়েছেন মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত। তিনি গান লিখেছেন এবং সে গানে নিজেই সুর করেছেন। একসময় সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে প্রকাশ করেন গানের অ্যালবাম ‘কর্কশ প্রেসনোট’। 

মাসুম আজিজ টেলিভিশন নাটকের সাথে সাথে তিনি চলচ্চিত্র এবং বাংলাদেশ বেতার এ অভিনেতা, গল্পকার এবং নির্দেশক হিসেবে কাজ করেন। ২০০৫ সালে ‘মমতাজ’ চলচ্চিত্র এর মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়। এরপর একে একে অভিনয় করেন ঘানি, গহিনে শব্দ, গেরিলা, গাড়িওয়ালা, লালচর, ইন্দুবালা, আমরা একটা সিনেমা বানাবোসহ আরও অনেক চলচ্চিত্রে। ২০০৬ সালে ঘানি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। ২০১০ সালে গহিনে শব্দ চলচ্চিত্রের জন্য অ্যামেরিকার ‘সাইলেন্ট রিভার ফিল্ম ফেস্টিভাল’ এ শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের অনুদানে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র ‘সনাতন গল্প’। চলচ্চিত্রটি ২০১৯ সালে ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এ শ্রেষ্ঠ সমালোচক ফিপ্রেসিজুরি পুরস্কার লাভ করেন। তার জীবনের দুঃখ কষ্ট বেদনা হয়েছেন অনেক, তার সহধর্মিণী অভিনেত্রী সাবিয়া জামান তার অভিনয় জীবনের প্রেরণার উৎস। তাকে উৎসাহিত করে নাট্য জগত এবং চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

মেয়ে প্রজ্ঞা আজিজ এবং ছেলে উৎস জামান উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন, তবে বাবা মার প্রেরণায় তারাও ছোট বেলা থেকে অভিনয় জগতে জায়গা করে নিয়েছেন। তার পরিবার ছিল একটি সামাজিক সাংস্কৃতিক সাহিত্য অঙ্গনের বাতিঘর। মাসুম আজিজের বড় ভাই সাবেক চাকসুর ভিপি, প্রগতিশীল লেখক, আজীবন কমিউনিস্ট বিপ্লবী বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুজ্জামান হিরা, মেজ ভাই প্রগতিশীল লেখক নাসিমুজ্জামান পান্না ছিলেন যুগ্ম সচিব, ছোট ভাই রতন গাউসুজ্জান একজন ভালো মঞ্চ অভিনেতা, গণসঙ্গীত শিল্পী। তার বোনরা ছিল অসাধারণ মেধাবী ছাত্রী , উচ্চ শিক্ষিত এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক সাহিত্য অঙ্গনের বাতিঘর। অভিনেতা মাসুম আজিজ ১৭ অক্টোবর ২০২২ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। কিংবদন্তি এ অভিনেতার আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: সংগঠক ও প্রাবন্ধিক