
বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব দীর্ঘদিনের। বড় রাজনৈতিক দলগুলোতে নেতাদের সন্তানরা পিতা-মাতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতিতে প্রবেশ করছেন। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই প্রবণতা সুস্পষ্ট। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-র জ্যেষ্ঠ নেতাদের উত্তরসূরিরা দলীয় মনোনয়ন পেতে মাঠে নেমেছেন। তাদের অনেকেই নিজেদের যোগ্যতা ও সাংগঠনিক দক্ষতায় এলাকায় প্রভাব বিস্তার করেছেন, আবার কেউ কেউ পরিবারের ঐতিহ্যের জোরে রাজনীতিতে এসেছেন।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব ব্যাপক। নেতারা প্রয়াত হলে বা তাদের উপস্থিতিতে তাদের সন্তানরা রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। এই প্রক্রিয়ায় মেধাবী, ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব তৈরি হয়, তবে কখনো শুধু পারিবারিক পরিচয়ের কারণে নেতৃত্বে আসা ব্যক্তিরাও থাকেন। বিএনপির ক্ষেত্রে এই প্রবণতা স্পষ্ট। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সন্তানরা মনোনয়নের জন্য প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। তাদের মধ্যে কেউ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় থেকে অবস্থান তৈরি করেছেন, আবার কেউ ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক মাঠে আলোচনায় এসেছেন।
নিচে বিএনপির কিছু উল্লেখযোগ্য তরুণ নেতার পরিচয় ও তাদের মনোনয়ন প্রত্যাশার বিবরণ দেওয়া হলো:
শামা ওবায়েদ, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক, ফরিদপুর-২ আসনে মনোনয়ন চাইছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বিএনপির সাবেক মহাসচিব প্রয়াত কেএম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে। শামা দীর্ঘদিন ধরে এই আসনে রাজনীতি করে আসছেন। তার বাবা এই আসন থেকে একাধিকবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। শামা সাংগঠনিক দক্ষতা ও স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করেছেন।
অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, বিএনপির খুলনা বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক, যশোর-৩ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি বিএনপির প্রয়াত স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামের ছেলে। তার বাবা এই আসন থেকে কয়েকবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। অমিত বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে নিজের প্রভাববলয় গড়ে তুলেছেন এবং স্থানীয় জনগণের মাঝে তার ইতিবাচক ইমেজ রয়েছে।
ব্যারিস্টার নওশাদ জমির, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা, পঞ্চগড়-১ আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের ছেলে। তার বাবা এই আসন থেকে পাঁচবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাবার বয়সের কারণে নওশাদ এবার মনোনয়ন চাইছেন এবং নিজের যোগ্যতায় এলাকায় পরিচিতি অর্জন করেছেন।
নিপুণ রায় চৌধুরী, ঢাকা জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা-৩ আসনে নির্বাচন করতে চান। তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান নিতাই রায় চৌধুরীর মেয়ে এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের পুত্রবধূ। তার বাবা মাগুরা-২ আসন থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী। নিপুণ ঢাকা জেলায় সাংগঠনিক কার্যক্রমে সক্রিয়।
তানভীর আহমেদ রবিন, ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির সদস্য সচিব, ঢাকা-৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি বিএনপির সাবেক এমপি সালাহউদ্দিন আহমেদের ছেলে। তানভীর ঢাকা দক্ষিণে দলের কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন।
ইশরাক হোসেন, ঢাকা দক্ষিণ বিএনপির এক নম্বর সদস্য, ঢাকা-৭ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। তিনি ঢাকার সাবেক মেয়র ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার ছেলে। ইশরাক ঢাকা দক্ষিণে মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তার বাবা একাধিক আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
চট্টগ্রামের পাঁচটি আসনে বিএনপির ছয় জ্যেষ্ঠ নেতার সাত সন্তান মনোনয়ন প্রত্যাশী। তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম-৫ আসনে মনোনয়ন চান। তিনি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এবং দলের কূটনৈতিক উইংয়ে কাজ করছেন। তার বাবা মীর নাছির, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মেয়র, ২০১৮ সালে এই আসন থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। হেলাল নগর ও জেলার রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছেন।
ফারজানা শারমিন পুতুল, নাটোর-২ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। পুতুল সাবেক প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান পটলের সন্তান। বাবার পদাংক অনুসরন করে বিএনপির রাজনীতিতে যোগ দেন তিনি। অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল বর্তমানে বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক কমিটি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটি, বিএনপি মিডিয়া সেলের সদস্য ও নাটোর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
হুম্মাম কাদের চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৭ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে। তার বাবা এই আসন ও ফটিকছড়ি থেকে নির্বাচন করেছিলেন। সাঈদ আল নোমান, চট্টগ্রাম-১০ আসনে মনোনয়ন চান। তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানের ছেলে। তার বাবা এই আসন থেকে একাধিকবার এমপি হয়েছিলেন।
ইসরাফিল খসরু, চট্টগ্রাম-১১ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ছেলে। ইসরাফিল দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপকমিটির সদস্য এবং এলাকার নেতাকর্মীদের দেখভাল করেন।
ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা, হাটহাজারী আসনে মনোনয়ন চান। তার বাবা সৈয়দ ওয়াহিদুল আলম এই আসন থেকে চারবার এমপি হয়েছিলেন। জহিরুল ইসলাম চৌধুরী ও মিশকাতুল ইসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১৫ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী। তাদের বাবা জাফরুল ইসলাম চৌধুরী এই আসনের এমপি ছিলেন।
ড. খন্দকার মারুফ হোসেন, কুমিল্লার যে কোনো আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ছেলে। খোন্দকার আকবর হোসেন বাবলু, মানিকগঞ্জ-১ আসনে মনোনয়ন চান। তিনি বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ছেলে।
নায়াব ইউসুফ, ফরিদপুর-৩ আসনে মনোনয়ন চান। তিনি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফের মেয়ে। তাহসিনা রুশদীর লুনা, সিলেট-২ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী, বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর স্ত্রী। মির্জা ফয়সাল আমিন, ঠাকুরগাঁও-২ আসনে মনোনয়ন চান। তিনি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভাই। নাসিমা আক্তার কল্পনা, প্রয়াত নেতা নাসির উদ্দিন পিন্টুর স্ত্রী, ঢাকার একটি আসনে মনোনয়ন চান।
এছাড়া আরও কিছু আসনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের উত্তরসূরিরা মনোনয়ন প্রত্যাশী। শেষ পর্যন্ত কতজন মনোনয়ন পান, সেটি জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
Comments