
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) ৩৬ দফা প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বৃহস্পতিবার (২৩ অক্টোবর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক শেষে এ প্রস্তাবসমূহ উপস্থাপন করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান।
ড. আবদুল মঈন খান পরে সাংবাদিকদের বলেন, সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিরপেক্ষ ভোটের প্রশ্নে ইসি এবং বিএনপি একমত। তিনি ভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে এবারের নির্বাচন যাতে দৃষ্টান্তমূলক উদাহরণ হয়, সেই ব্যবস্থা নিতে ইসিকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দেন।
মঈন খান আরও বলেন, গত ১৫ বছরে প্রশাসনকে দলীয়করণ করা হয়েছে, তাই বিতর্কিত কর্মকর্তাদের নির্বাচনের দায়িত্বে রাখা যাবে না।
বিএনপির ৩৬ দফা প্রস্তাবের সারসংক্ষেপ:
১. নিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণ: বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের শতভাগ নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলে এই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে হবে।
২. মাঠ প্রশাসন ঢেলে সাজানো: নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে ডিসি, ইউএনও, এসপি, ওসি এবং ক্ষেত্রমতে কমিশনার, পুলিশ কমিশনারসহ মাঠ প্রশাসনকে সম্পূর্ণ ঢেলে সাজাতে হবে। জাতীয় নির্বাচনের পূর্বে জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে এ ধরনের পুনর্বিন্যাস একটি রুটিন প্রক্রিয়া, যা অবশ্য করণীয়।
৩. বিতর্কিত কর্মকর্তাদের বাদ দেওয়া: বিগত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের অবৈধ নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সব বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের কোনো ধরনের নির্বাচনী দায়িত্ব দেওয়া যাবে না।
৪. রিটার্নিং অফিসার নিয়োগ: রিটার্নিং অফিসার হিসেবে প্রশাসনের অফিসারদের পাশাপাশি সম্ভাব্য ক্ষেত্রে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তা (ইলেকশন সার্ভিস) কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে দক্ষ, সৎ, অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৫. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ: নির্বাচনকালে সমগ্র প্রক্রিয়ায় জড়িত বেসামরিক প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব কর্মকর্তার বদলি, পদায়ন, অবস্থান, দায়িত্ব ও তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণের ভার নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে নিতে হবে। সব ভোটকেন্দ্রে নির্বাচনের কমপক্ষে এক সপ্তাহ পূর্ব হতে সামরিক বাহিনী, বিজিবি, র্যাব, পুলিশসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
৬. ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা: নির্বাচনী আচরণবিধি প্রতিপালন, অবলোকন এবং নির্বাচনকে জনগণের নিকট বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য বিচার বিভাগীয় ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদেরও ম্যাজিস্ট্রেরিয়াল ক্ষমতা প্রদান করতে হবে।
৭. সিসি ক্যামেরা স্থাপন: ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগ অবাধ, নির্বিঘ্ন, স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান করার জন্য ভোটকেন্দ্রের গোপনীয় কক্ষের কার্যক্রম ব্যতীত ভোটকেন্দ্রের অন্যান্য অভ্যন্তরীণ দৃশ্য বাইরে থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ সৃষ্টির নিমিত্ত সিসি ক্যামেরা সংস্থাপনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. অভিযোগ নিরসন কেন্দ্র: নির্বাচনী সময়সূচি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি জেলা নির্বাচন অফিসারের কার্যালয়ে এবং প্রত্যেক উপজেলা বা থানায় একটি করে অভিযোগ নিরসন কেন্দ্র চালু করতে হবে। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কোনো অভিযোগ প্রাপ্তির ১২ ঘণ্টার মধ্যে বা যত দ্রুত সম্ভব তা নিষ্পত্তি করে অভিযোগকারীকে লিখিতভাবে অবহিত করতে হবে।
৯. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন স্থগিত: জুলাই ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটি বা গভর্নিং বডি গঠিত হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তড়িঘড়ি করে ১ নভেম্বরের মধ্যে নতুন করে নির্বাচন সম্পন্নের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এই কার্যক্রম অবিলম্বে স্থগিত করতে হবে।
১০. ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগে নিরপেক্ষতা: ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ প্রদান করা যাবে না (যেমন: ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল, ইবনে সিনা ইত্যাদি)।
১১. মামলা প্রত্যাহার: লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে জুলাই ’২৪ ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের নেতাকর্মীদের নামে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে দায়েরকৃত মিথ্যা, বানোয়াট ও গায়েবি মামলাসমূহ নির্বাচনী সময়সূচি জারির পূর্বেই প্রত্যাহারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১২. অস্ত্র জমা নিশ্চিতকরণ: নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পূর্বেই বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে দলীয় বিবেচনায় প্রদত্ত সকল অস্ত্র সরকারের কাছে জমা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
১৩. অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার: সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা অগণিত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১৪. সীমান্তে নজরদারি: সীমান্ত পথে আসা অবৈধ অস্ত্র, নকল টাকা, কালো টাকার অনুপ্রবেশ বন্ধের ব্যবস্থা করতে হবে।
১৫. চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল: সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানে এবং দূতাবাসগুলোতে চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিল করতে হবে।
১৬. অবাধ, বিশ্বাসযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন: নির্বাচন অবাধ, বিশ্বাসযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও পক্ষপাতহীন হতে হবে। ভোটারদের স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগে সম্ভাব্য সব প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগের অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
১৭. ত্রুটিমুক্ত ফলাফল: নির্বাচনে সম্ভাব্য সব কারচুপির সুযোগ প্রতিরোধ করে নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্ত ফলাফল নিশ্চিত করতে হবে।
১৮. অর্থ ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ: ভোটকেন্দ্রে ভোটাধিকার প্রয়োগে অর্থশক্তি, পেশিশক্তি ব্যবহার ও প্রভাব প্রতিরোধ করতে হবে।
১৯. বহিরাগতদের প্রচারণা নিষিদ্ধ: নির্বাচনী এলাকায় বহিরাগত কোনো লোক প্রচারণায় অংশ নিতে পারবে না।
২০. ইসি সদস্যদের নিরপেক্ষতা: নির্বাচন কমিশনের সদস্যদের গৃহীত সাংবিধানিক শপথের প্রতি অনুগত থেকে নিরপেক্ষ ও সাহসী হয়ে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
২১. দৃশ্যমান নিরপেক্ষতা: নির্বাচন যে অবাধ, নিরপেক্ষ ও কারচুপিমুক্ত হচ্ছে তা দেশ ও জাতির কাছে দৃশ্যমান হতে হবে।
২২. ভোটারদের নিরাপত্তা: সব ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
২৩. বিতর্কিত বক্তব্য রোধ: কোনো রাজনৈতিক দল, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী কর্তৃক বিতর্ক তৈরি করে এমন কোনো বক্তব্য যাতে না দেয় তার প্রাক ব্যবস্থা থাকতে হবে।
২৪. সাম্প্রদায়িক অপপ্রচার রোধ: নির্বাচনে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায়- এমন অপপ্রচার রোধ করতে হবে।
২৫. ধর্মীয় প্রলোভন ও ভীতি প্রদর্শন রোধ: ভোটারদের প্রভাবিত করে এমন ধর্মীয় প্রলোভন বা ধর্মীয় দণ্ড প্রদানের ভীতি প্রদর্শন রোধ করতে হবে।
২৬. অর্থ, দুর্নীতি ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন: অর্থ, দুর্নীতি ও সহিংসতা অর্থাৎ Trippple ‘C’ (Cash, Corruption, Criminality)- এর অসৎ প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে।
২৭. ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ: ভোটকেন্দ্র নির্ধারণে বিধি-বিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ভোটকেন্দ্রকে ভোটারদের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে এবং কম সংখ্যক ভোটার নিয়ে ভোটকেন্দ্র নির্ধারণ করাই উত্তম।
২৮. ভোটার সচেতনতা: নির্বাচনের যাবতীয় নিয়মকানুন সম্পর্কে ভোটারসহ আপামর জনসাধারণকে পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশন, লিফলেট ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সচেতন করতে হবে।
২৯. নির্বাচন কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতা: নির্বাচন কর্মকর্তা (বিশেষ বিধান) আইনে বর্ণিত সব নির্বাচনী কর্মকর্তাদের (রিটার্নিং অফিসার, সহকারী রিটার্নিং অফিসার, নির্বাহী ও বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট, ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাবৃন্দ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তা ও সদস্যবৃন্দ) সার্বিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে হবে। কোনো গাফিলতি পরিলক্ষিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে তাৎক্ষণিক প্রত্যাহার ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৩০. সন্ত্রাসী তৎপরতা দমন: ভোটকেন্দ্রের ৪০০ গজ ব্যসার্ধের মধ্যেই কেবল নয় বরং এর বাইরেও নির্বাচনী এলাকার যেকোনো স্থানে সন্ত্রাসী তৎপরতা তাৎক্ষণিকভাবে দমন করতে হবে।
৩১. পর্যবেক্ষক নিয়োগ: স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের তাদের নিজস্ব জেলায় দায়িত্ব প্রদান করা যাবে না। তাছাড়া রাজনৈতিক মতাদর্শী বা কোনো দলীয় ভাবধারা প্রচার করে এমন পর্যবেক্ষণ সংস্থাকে পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেওয়া যাবে না।
৩২. আনসার ও ভিডিপি মোতায়েন: আনসার ও ভিডিপি মোতায়েনের ক্ষেত্রে কোনক্রমেই নিজ জেলায় মোতায়েন করা যাবে না।
৩৩. কমিউনিটি পুলিশ: কমিউনিটি পুলিশকে কোনোভাবেই ভোটকেন্দ্রে মোতায়েন করা যাবে না।
৩৪. ভোটার তালিকা সরবরাহ: ছবিসহ ভোটার তালিকা পোলিং পার্সোন্যালসহ সকল পোলিং এজেন্টদেরকেও যথাসময়ে সরবরাহ করতে হবে।
৩৫. ফলাফল ঘোষণা: ভোট গণনা শেষ হবার পরপরই নির্বাচনের ফলাফল প্রতিটি কেন্দ্র হতে সরাসরি ঘোষণা করতে হবে।
৩৬. প্রবাসীদের ভোটাধিকার: প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগ আইনানুগ স্বচ্ছতার সঙ্গে করতে হবে। বিভিন্ন দেশে পোস্টাল ব্যালটে ভোট দানে ইচ্ছুক রেজিস্টার্ড প্রবাসী ভোটারদের তালিকা রাজনৈতিক দলকে যৌক্তিক সময়ের পূর্বেই সরবরাহ করতে হবে।
Comments