রাজনীতিতে নেতার ব্যবহৃত বাহন কখনোই কেবল যাতায়াতের মাধ্যম নয়; এটি অনেক সময় হয়ে ওঠে একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক বার্তা, কৌশল ও প্রতীকের অংশ। সম্প্রতি বাংলাদেশে শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বড় নেতাদের সুনির্দিষ্ট বাস ব্যবহার নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে—কেন বিলাসবহুল এসইউভি বা প্রথাগত খোলা ট্রাকের বদলে নেতারা বাস বেছে নিচ্ছেন? আর এই প্রবণতা কি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে নতুন?
বিশ্ব রাজনীতিতে প্রচারণার কাজে বাসের ব্যবহার বেশ পুরনো ও জনপ্রিয়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে একে বলা হয় ‘ক্যাম্পেইন বাস’। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা এই বাসে করে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে ঘুরে বেড়ান। এই বাসগুলো মূলত এক একটি ‘চলন্ত রাজনৈতিক মঞ্চ’। ভেতরে থাকে মিডিয়া ব্রিফিংয়ের ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ইউনিট ও ছোট ছোট বৈঠকের জায়গা।
যুক্তরাজ্যে লেবার পার্টির টনি ব্লেয়ার ১৯৯৭ সালের নির্বাচনে লাল রঙের ব্র্যান্ডেড বাস ব্যবহার করে ইতিহাস গড়েছিলেন। জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল থেকে শুরু করে তুরস্কের রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ান কিংবা পাকিস্তানের ইমরান খান—সবাই বাসকে জনসম্পৃক্ততার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছেন। এমনকি কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো সাধারণ ট্রাকে বা বাসে ভ্রমণ করে জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগের বার্তা দিতেন।
রাজনীতিতে বাসের গুরুত্ব মূলত তিনটি বিশেষ কারণে:
১. সর্বোচ্চ দৃশ্যমানতা: বাস আকারে অনেক বড় ও উঁচু হওয়ায় ভিড়ের মধ্যেও নেতার অবস্থান সহজে চোখে পড়ে। এটি সহজে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
২. জনসম্পৃক্ততার প্রতীক: এসইউভি বা দামী ব্যক্তিগত গাড়ি আভিজাত্য ও জনবিচ্ছিন্নতার প্রতীক হতে পারে। অন্যদিকে, বাস হলো গণপরিবহন। নেতা যখন বাসে চলাচল করেন, তখন তিনি একটি অঘোষিত বার্তা দেন—‘আমি জনগণের মধ্যেই আছি।’ এটি একটি গণমুখী ইমেজের বহিঃপ্রকাশ।
৩. নিরাপত্তা ও নিয়ন্ত্রণ: বাইরে থেকে সাধারণ বাস মনে হলেও আধুনিক এই যানগুলো বুলেটপ্রুফ ও উচ্চ নিরাপত্তার প্রযুক্তিতে ঠাসা থাকে। ফলে নেতার দৃশ্যমানতা বজায় রেখেও ঝুঁকি কমানো সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, এখানে বড় সমাবেশ বা মিছিলে ‘খোলা ট্রাক’ ছিল প্রধান বাহন। নেতারা ট্রাকে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতেন, যা মূলত আন্দোলনের উত্তাপ ও আবেগী রাজনীতির দৃশ্যমান রূপ ছিল। বাস মূলত ব্যবহৃত হতো কর্মী পরিবহনের জন্য।
তবে সম্প্রতি ১৭ বছর পর দেশে ফিরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান যখন বিমানবন্দর থেকে গণসংবর্ধনা মঞ্চ, জাতীয় স্মৃতিসৌধ কিংবা হাসপাতালে অসুস্থ মাকে দেখতে যাওয়ার জন্য ধারাবাহিকভাবে একটি নির্দিষ্ট বাস ব্যবহার করছেন, তখন সেটি একটি নতুন মাত্রার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি কেবল একটি পরিবহন নয়, বরং পরিকল্পিত রাজনৈতিক যোগাযোগের অংশ। একই বাসের পুনঃপুন ব্যবহার একে একটি ‘ব্র্যান্ড’ বা প্রতীকে পরিণত করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি তুলনামূলকভাবে নতুন। এখানে খোলা ট্রাকের উচ্চকণ্ঠ ও আবেগপ্রবণ রাজনীতির সমান্তরালে এখন দেখা যাচ্ছে নিয়ন্ত্রিত ও পরিকল্পিত প্রতীকী দৃশ্যমানতার প্রয়াস। পশ্চিমা দেশগুলোর মতো বাংলাদেশেও এখন শুধু মঞ্চের বক্তৃতা নয়, নেতার চলাচলের ধরন এবং বাহনটিও বার্তার অংশ হয়ে উঠছে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন মেটানোর পাশাপাশি বাসের ব্যবহার নেতাদের একটি আধুনিক ও সুশৃঙ্খল ভাবমূর্তি তৈরিতে সাহায্য করছে। তারেক রহমানের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই ‘বাস কালচার’ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বাহন ব্যবহারের নয়া ধারারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।




Comments