Image description

আমার মেয়েটিকে দেখবেন ওস্তাদ যেন ভালোভাবে গান ধরতে পারে। ছোট্ট মেয়েটির আম্মার এমন অনুরোধে ওস্তাদ সম্মত হলেন গান শেখাতে। সেকি চঞ্চল। এদিক সেদিক ছোটাছুটি মেয়েটির। যেন ধানের শিষে রৌদ্র ছায়ায় প্রজাপতির খেলারে ভাই লুকোচুরির খেলা। ওস্তাদ যে মাটির মানুষ তার মমতায় কমতি ছিল না। তার সরগম দিয়ে এমন আকর্ষণ তৈরি করলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতন সংগীতে বুঁদ হয়ে গেল মেয়েটি। এমনি করে প্রায় তেরো বছর ওস্তাদের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নিলেন তিনি। 

মেয়েটির বড় বোনও ওস্তাদের শিখন পদ্ধতিতে মুগ্ধ হয়ে দীর্ঘ ২২ বছর ওস্তাদের কাছে তালিম নেন। তারা হয়ে উঠলেন গানের জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। সেই ছোট্ট মেয়েটি আজকের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন আর বড় মেয়েটি কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী নিলুফার ইয়াসমিন। কিংবদন্তি শিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদীৃ তার জীবনের গান বইতে লিখেছেন ‘ওস্তাদের কাছ থেকে কিছু নিতে হলে যে ধৈর্য এবং অধ্যবসায় প্রয়োজন, তা হয়তো আমার ছিল না। 

এ প্রসঙ্গে আর এক অত্যন্ত গুণী সংগীত শিক্ষক ওস্তাদ পি. সি. গোমেজের নামটি অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। শিক্ষাদানের ব্যাপারে এমন আন্তরিক এবং আগ্রহী সংগীত শিক্ষক খুব কমই দেখা যায়। নিলুফার ইয়াসমিন, সাবিনা ইয়াসমিনসহ অনেক শিল্পীই তার কাছ থেকে তালিম নিয়েছেন। আমিও তার কাছে কিছুদিন তালিম নিয়েছি। তিনি নিজে বাসায় এসে আমাকে শেখাতেন। কোনো দিন সময়ের অভাবে শিখতে না চাইলে অন্তত ১০ মিনিট হলেও তিনি জোর করে বসিয়ে শেখাতেন। এমন নিবেদিতপ্রাণ সংগীত শিক্ষক বিরল। 

বয়সজনিত অসুস্থতার ফলে তিনি বেশি দিন আর শেখাতে পারেননি। আমারও উচ্চাঙ্গ সংগীতের পদ্ধতিগত তালিমের এখানেই ইতি।’ ওস্তাদের আরেক গর্বিত শিষ্য লোকসংগীতের বরপুত্র প্রখ্যাত শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় ওস্তাদের স্মৃতিচারণে বলেন, প্রায় পাঁচ বছর আমি ওস্তাদ পি. সি. গোমেজের কাছ থেকে উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নেই। সংগীত জগতে ওনার অবদান অনেক। ওস্তাদ পি. সি. গোমেজ চারটে খানি কথা না। তিনি ছিলেন পণ্ডিত বারীণ মজুমদার (প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ, সংগীত মহাবিশ্ববিদ্যালয়), ওস্তাদ মুন্সি রইসউদ্দিন, বেগম ফুলঝুড়ি খান তাদের সমসাময়িক। 

অদ্যাবধি ওনাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সম্মানে সম্মানিত করেনি যা জাতির জন্য খুবই দুঃখজনক ব্যাপার। আমি ক্ষোভ প্রকাশ করছি। উত্তর ভারতীয় সাংস্কৃতিক এবং শৈল্পিক কেন্দ্র এবং বহুসংস্কৃতির শহর লখনউ’তে অনেক প্রসিদ্ধ ওস্তাদের কাছে সংগীতে তালিম নিয়েছিলেন ওস্তাদ পি. সি. গোমেজ। ১৯০৪ সালের ২৮ এপ্রিল পৈত্রিক নিবাস ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জের অধীন বক্সনগর গ্রামে জন্ম নেন তিনি। বাবা যোসেফ গোমেজ ও মা আন্তনিয়া গোমেজ উভয়ই সংগীত অনুরাগী ছিলেন। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তার ঠাকুরদাদা ভিনসেন্ট গোমেজ দেহতাত্ত্বিক গান গাইতেন। 

ওস্তাদ পি. সি. গোমেজের পূর্বপুরুষ একসময় দোহার উপজেলার মালিকান্দা পদ্মার পাড়ে থাকতেন। প্রায় ১৫০ বছর আগে ওস্তাদ পি. সি গোমেজের ঠাকুরদাদা আঠারো গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। আর সেই ঠাকুরদাদার তিন ছেলের এক ছেলে যোসেফ গোমেজের ঘরে জন্ম নেন পি. সি গোমেজ। ওস্তাদ পি. সি গোমেজের নাম দি অক্সর্ফোড এনসাইক্লোপিডিয়া অব দি মিউজিক অব ইন্ডিয়াই সংক্ষেপে পি. সি গোমেজ  এবং একজন প্রখ্যাত ওস্তাদ ও কণ্ঠশিল্পী হিসেবে লিপিবদ্ধ আছে।
 
কবি ও ফোকলোরবিদ ড. তপন বাগচী তার স্মৃতি চারণে বলেন, ‘বাংলাদেশে সংগীত জগত যখন আলোর মুখ দেখার প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়েছিল, তখন এক চির নিবেদিত অভিভাবকের মতন হাল ধরেন ওস্তাদ পি. সি গোমেজ। গানের ব্যাকরণ এবং গানের প্রতি তার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভালোবাসার জন্ম দিয়েছিলেন। তিনি রচনা করেছিলেন গানের সরগম বই। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি থেকে ওনার রাগ রংগ বিলাসিনী নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল।’ 

ওস্তাদের তানপুরাটা হারিয়ে গেছে। ওস্তাদ পি. সি গোমেজ নেই কোথাও। কিন্তু ওস্তাদের তানপুরাটার মতন হারিয়ে যায়নি ওস্তাদের শিষ্যরা। ওস্তাদের আহত রাগ রাগিনীরা এখনও কাঁদে মালকার, দেশহার, ভ‚পালী গুর্জরী  টংকী’তে, এখনও হয় বৃষ্টি ঝুম ঝুম সৃষ্টিতে। তিনি এখনও আছেন তার রাগ ভৈরব-রাগিনী মধ্যমাদি, সুরে সুরে সিন্দুরা’য়, পাখিগুলো এখনও অবাক হয় তার শিষ্যদের শুদ্ধ সুরের সুর গড়ায়। তিনি ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ৪ ডিসেম্বর বার্ধক্যজনিত কারণে পরলোকগত হন।

লেখক: কলামিস্ট