Image description

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে জোরালো বক্তব্যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান এবং পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি সুশাসন, সামাজিক অন্তর্ভুক্তি ও টেকসই উন্নয়নকে সরকারের উন্নয়ন কৌশলের মূল ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের দুর্নীতি ও সম্পদ পাচারের তীব্র সমালোচনা করেন।

দুর্নীতির ভয়াবহতা ও অর্থনৈতিক ক্ষতি

ড. ইউনূস বলেন, "বিগত দেড় দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, জবাবদিহি ছাড়া যেকোনো উন্নয়ন ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর। রাজনৈতিক হীনস্বার্থ ও দুর্নীতির উদ্দেশ্যে গৃহীত অবকাঠামো প্রকল্প শুধু অর্থনীতির ওপর চাপই বাড়ায়নি, জনগণের কোনো কল্যাণও করেনি।" তিনি জানান, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিগত সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি ও সম্পদ চুরির বিস্তৃতি আবিষ্কার করেছে, যা দেশের অর্থনীতিকে ভয়ানক নাজুক ও ভঙ্গুর করে ফেলেছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, "পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার আমাদের শীর্ষ অগ্রাধিকার। গত ১৫ বছরে দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি ডলার অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করা হয়েছে।"

সম্পদ পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার আহ্বান

প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সম্পদ ফেরত আনার প্রক্রিয়া সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনি জটিলতা ও প্রতিবন্ধকতার কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, "সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর দৃঢ় সদিচ্ছা ছাড়া এই অবৈধ সম্পদ পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।" তিনি যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান পাচারকৃত সম্পদ গচ্ছিত রাখার সুযোগ দিচ্ছে, তাদের এই অপরাধের শরিক না হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, "এই সম্পদ প্রকৃত মালিক অর্থাৎ কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ করদাতাদের কাছে ফিরিয়ে দিন।" তিনি উন্নয়নশীল দেশ থেকে সম্পদ পাচার রোধে কঠোর আন্তর্জাতিক বিধিবিধান প্রণয়ন ও তার প্রয়োগ নিশ্চিত করার প্রস্তাব করেন।

আর্থিক সংস্কার ও সুশাসনের প্রতিশ্রুতি

ড. ইউনূস দেশের আর্থিক খাতে সংস্কারের বিষয়ে বলেন, "রাজস্ব খাতে ঐতিহাসিক সংস্কারের পাশাপাশি আমরা বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করেছি। ব্যাংক খাতে অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ, নতুন ব্যাংক রেজোলিউশন অধ্যাদেশ ও আসন্ন ডিপোজিট প্রটেকশন অধ্যাদেশের মাধ্যমে শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা আনছি।" তিনি পুঁজিবাজারে সংস্কার টাস্কফোর্স ও শক্তিশালী তদন্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে তদারকি আধুনিকীকরণের কথাও উল্লেখ করেন।

তিনি আরও বলেন, "সরকারি ক্রয় ব্যবস্থায় ডিজিটাল টেন্ডারিং বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং স্বার্থের সংঘাত সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। নতুন পাবলিক অ্যাকাউন্টস অডিট অধ্যাদেশের মাধ্যমে জবাবদিহিতা আরও জোরদার করা হয়েছে।"

বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা

অন্তর্বর্তী সরকার বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে কাজ করছে। ড. ইউনূস জানান, বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো ১৯টি সংস্থাকে একীভূত করে কাস্টমস প্রক্রিয়া সহজ করছে। দ্রুত বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিশেষায়িত বাণিজ্য আদালত গঠিত হয়েছে। বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ওয়ান-স্টপ সার্ভিস প্রদানের জন্য সমন্বয় কমিটি গঠন করেছে। ভিসা ও ওয়ার্ক পারমিট প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে, এবং এফডিআই হিটম্যাপ ও জাতীয় সেমিকন্ডাক্টর টাস্কফোর্স বিনিয়োগকারীদের কাছে উচ্চ সম্ভাবনাময় খাতগুলোর তথ্য স্বচ্ছভাবে তুলে ধরছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে গত আগস্টে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ২৭.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, যা বাণিজ্য লজিস্টিকসের উন্নতি নির্দেশ করে। এসব উদ্যোগ অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করছে এবং বিনিয়োগকে নিরাপদ করছে।

প্রবাসীদের অবদান

ড. ইউনূস বলেন, "অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে আমাদের প্রবাসীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তারা বিদেশের মাটিতে কঠোর পরিশ্রম করে প্রতি মাসে দেশে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।" তিনি যোগ করেন, প্রবাসীরা স্বাগতিক দেশগুলোতেও বহুল চাহিদাসম্পন্ন সেবা প্রদান করছেন, যা উভয় দেশের জন্যই লাভজনক।

টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির স্বপ্ন

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, "আমরা এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাই, যা জনগণের কল্যাণে কাজ করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হবে।" তিনি জোর দেন, জবাবদিহিহীন উন্নয়ন প্রকল্পের ফলে অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, যা জনগণের জন্য ক্ষতিকর। জাতিসংঘের মঞ্চ থেকে দেওয়া এই বক্তব্যে ড. ইউনূস বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন, যা দেশের সাধারণ মানুষের জন্য একটি আশার বার্তা বহন করে।