Image description

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে যে আদেশ জারির সুপারিশ জাতীয় ঐকমত্য কমিশন করতে যাচ্ছে, তাতে গুরুত্ব পাবে না রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত)। গত রোববার সন্ধ্যার বৈঠকের পর গতকাল কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের কয়েকজন সদস্য মতামতে জানিয়েছেন, ভিন্নমতসহ গণভোট সম্ভব না। ভিন্নমত রেখে সংস্কার এগিয়ে নেওয়াও অসম্ভব। 

কমিশন সূত্র ও বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্যরা এ তথ্য জানিয়েছেন। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, আদেশের খসড়া প্রণয়ন চলছে। আশা করা হচ্ছে তা দু-তিন দিনের মধ্যে চূড়ান্ত করা সম্ভব। ২৪ অক্টোবরের মধ্যে সরকারকে চূড়ান্ত সুপারিশ দিতে চায় কমিশন। যাতে কমিশনের মেয়াদের মধ্যে আদেশ জারির জন্য সরকারের হাতে এক সপ্তাহ সময় থাকে।
আগের দিন কমিশন ও বিশেষজ্ঞ প্যানেলের আলোচনা হয়, সনদ নয়; গণভোট হবে আদেশের ওপর। নাগরিকরা ‘হ্যাঁ-না’ ভোটের মাধ্যমে জানাবেন, তারা এই আদেশ অনুমোদন করেন কিনা। আদেশের প্রাক-খসড়া অনুযায়ী গণভোটের ব্যালটে প্রশ্ন থাকবে, ‘আপনি সরকার ঘোষিত আদেশ সমর্থন করেন কিনা?’

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্রাক-খসড়া চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। সোমবার তারা কমিশনকে কিছু মতামত জানিয়েছেন। এর একটি হলো সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নয়, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে সরকারকে আদেশ জারি করতে হবে। কারণ, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌম কর্তৃত্বের প্রয়োগ ঘটেছে। এই কর্তৃত্ববলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায় অনুযায়ী এ সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারি করবে। 


বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অতীত অভিজ্ঞতা হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার দৃঢ় অবস্থান নিতে পারে না। রাজনৈতিক চাপের কারণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেও বাস্তবায়ন করতে পারে না। তাই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারিতে সরকারকে দৃঢ় হতে হবে। আদেশ জারি ছাড়া গণভোট আয়োজনের আইনি পথ নেই। 

কমিশনের একজন সদস্য বলেছেন, সংস্কারের জন্য শক্ত অবস্থান নিতে গত জুলাই থেকেই সরকারকে বারবার বলা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টাও আশ্বাস দিয়েছিলেন, তিনি শক্ত অবস্থান নেবেন; অভ্যুত্থানের ম্যান্ডেট পূরণে সংস্কার করবেন। কিন্তু পরে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতার বিষয়ে অবস্থান নেননি; বরং সংস্কারকে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ওপর ছেড়ে দেন। 
কমিশন সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে যেসব সুপারিশ করা হবে, এর একটি হবে সরকারকে শক্ত হওয়ার আহ্বান। 


গত ১৭ অক্টোবর রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে সংস্কারের ৮৪টি সিদ্ধান্ত রয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনসহ ৯টি মৌলিক সংস্কারে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। দলটি জানিয়েছে, যেসব সংস্কারে ভিন্নমত রয়েছে, ক্ষমতায় গেলে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে না।

বিএনপি জানিয়েছিল, নোট অব ডিসেন্ট না রাখলে সনদে সই করবে না। তাই দলটির দাবিতে শেষ সময়ে যুক্ত করা হয়েছে, যেসব সংস্কারে ভিন্নমত রয়েছে, তা নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করতে পারবে রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচনে জয়ী হলে সে অনুযায়ী সংস্কার করতে পারবে।

কমিশন সূত্র বলেছে, বিশেষজ্ঞরা মতামতে জানিয়েছেন, এই বিধান গণভোটে থাকলে পুরো সংস্কারই ঝুঁকিতে পড়বে। কারণ, ৮৪ সংস্কারের মাত্র ৮ থেকে ১০টিতে সব দলের ঐকমত্য রয়েছে। বাকিগুলোতে কোনো না কোনো দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। যেমন সনদে বলা হয়েছে, সংসদের উভয় কক্ষে বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হবেন। বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, এনসিপিসহ ২৯ দল এতে একমত। ভিন্নমত জানিয়েছে বাংলাদেশের বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ নামে একটি দল। 

কমিশনের একজন সদস্য বলেছেন, যদি সব নোট অব ডিসেন্ট গ্রহণ করা হয়, তাহলে সংস্কার হবে না। যেসব সংস্কারে শতভাগ ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোই কার্যকর করা হবে– এই সিদ্ধান্ত গণভোটে হলেও লাভ হবে না। নোট অব ডিসেন্টের উদাহরণ দিয়ে ভবিষ্যতে ক্ষমতাসীন দল সংস্কার থেকে বিরত থাকতে চাইলে কারও কিছু করার থাকবে না। পুরো সংস্কারই ব্যর্থ হবে। তাই বিশেষজ্ঞরা নোট অব ডিসেন্ট বিবেচনা না করার পক্ষে।

কমিশন সূত্র জানিয়েছে, এ সমস্যা দূর করতে জুলাই সনদ নয়, গণভোট হবে আদেশের ওপর। আদেশ সনদের অংশ হবে না, বরং সনদ হবে আদেশের অংশ। জনগণ গণভোটে আদেশ অনুমোদন করলে আগামী সংসদ সে অনুযায়ী জুলাই সনদ বাস্তবায়ন করবে। গণভোটে নোট অব ডিসেন্ট থাকবে না। নোট অব ডিসেন্ট আগামী সংসদ কীভাবে সমন্বয় করা হবে, তা থাকবে আদেশে। 

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেছেন, মঙ্গল বা বুধবার বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে আবার বৈঠকে বসবে কমিশন। চূড়ান্ত করা হবে আদেশের খসড়া।