Image description

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) কিছু সেনা গাজায় তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, যেখানে তারা বেসামরিক নাগরিকদের প্রতি আইডিএফের বর্বর আচরণ এবং নৈতিকতার অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। ব্রিটিশ টেলিভিশন আইটিভির প্রামাণ্যচিত্র ‘ব্রেকিং র‌্যাঙ্কস: ইনসাইড ইসরায়েলস ওয়ার’-এ এই অভিযোগ উঠে এসেছে, যা সোমবার সন্ধ্যায় যুক্তরাজ্যে প্রচারিত হওয়ার কথা।

প্রামাণ্যচিত্রটিতে দেখা গেছে, আইডিএফের অনেক সেনা নাম প্রকাশ করে বা পরিচয় গোপন রেখে তাদের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন। তাদের বর্ণনায় উঠে এসেছে এক নিয়ন্ত্রণহীন যুদ্ধ পরিস্থিতি, যেখানে অফিসারদের খেয়ালখুশিমতো বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছে।

ড্যানিয়েল নামে একজন ট্যাঙ্ক ইউনিট কমান্ডার বলেন, "যদি তুমি সীমাহীনভাবে গুলি চালাতে চাও, সেটা পারো। কেউ তোমাকে আটকাবে না।" ক্যাপ্টেন ইয়োতাম ভিল্ক নামে আরেক কর্মকর্তা জানান, আইডিএফের প্রশিক্ষণে সেনাদের 'মিন্স, ইনটেন্ট অ্যান্ড অ্যাবিলিটি' (শত্রুর হাতে অস্ত্র, ক্ষতির ইচ্ছা এবং তা করার সামর্থ্য) শেখানো হলেও গাজায় এর কোনো অর্থ ছিল না। তার ভাষায়, "কেউ যদি নিষিদ্ধ এলাকায় হাঁটে, তাহলেই সন্দেহভাজন। বয়স যদি ২০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে হয়, তাহলেই সম্ভাব্য শত্রু।"

'এলি' নামে পরিচিত আরেক সৈনিক বলেছেন, "জীবন-মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিয়ম বা ফায়ারিং প্রটোকল দিয়ে হয় না। মাঠের কমান্ডারের বিবেকই শেষ কথা। এসব পরিস্থিতিতে শত্রু বা সন্ত্রাসী কাকে বলা হবে তা সম্পূর্ণ মনগড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে।" তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, দ্রুত বা ধীরে হাঁটা, বা তিনজন একসাথে হাঁটলে তাদের সামরিক ফরমেশনে থাকার সন্দেহ—এসবই সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এলি একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে এক সিনিয়র অফিসার একটি ট্যাঙ্ক থেকে গোলা ছুড়ে একটি বেসামরিক ভবন ধ্বংস করার নির্দেশ দেন, যদিও একজন ব্যক্তি ছাদে কাপড় শুকাচ্ছিলেন। অফিসার তাকে 'স্পটার' (শত্রুর নজরদার) বলে দাবি করেন, যদিও তার হাতে কোনো দূরবীন বা অস্ত্র ছিল না। এই আক্রমণে ভবনের অর্ধেক ধসে পড়ে এবং অনেক মানুষ মারা যায় ও আহত হয়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজায় নিহতদের মধ্যে প্রায় ৮৩ শতাংশই বেসামরিক, যা আধুনিক যুদ্ধে নজিরবিহীন। আইডিএফ এক লিখিত বিবৃতিতে আইনের শাসনের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ থাকার কথা জানালেও, প্রামাণ্যচিত্রে সাক্ষাৎকার দেওয়া কিছু সেনা জানিয়েছেন যে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরায়েলি রাজনীতিক ও ধর্মীয় নেতাদের 'প্রত্যেক ফিলিস্তিনি এখন তাদের প্রধান টার্গেট' মন্তব্য তাদের প্রভাবিত করেছিল।

সেনাবাহিনীর চরমপন্থী ধর্মীয় নেতা রাব্বি আভ্রাহাম জারবিভ এই প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাব ছড়িয়ে দিতে ভূমিকা রেখেছেন। মেজর নেতা কাসপিন বলেন, "রাব্বি আমার পাশে বসে আধাঘণ্টা ধরে বোঝালেন যে আমাদেরও ৭ অক্টোবরের মতো হতে হবে। আমাদের প্রতিশোধ নিতে হবে সবার ওপর, এমনকি বেসামরিকদের ওপরও। যেন আমরা কোনো পার্থক্য না করি। এটাই একমাত্র পথ।"

রাব্বি আভ্রাহাম জারবিভ, যিনি গাজায় ৫০০ দিনেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন, প্রামাণ্যচিত্রে বলেন, "ওখানে সবকিছুই এক বিশাল সন্ত্রাসী অবকাঠামো।" তিনি শুধু ফিলিস্তিনি পাড়াগুলো ধ্বংসের ধর্মীয় বৈধতা দেননি, বরং নিজেই সামরিক বুলডোজার চালিয়েছেন এবং দাবি করেছেন যে তিনিই এই কৌশলটির উদ্ভাবক, যা পরে পুরো আইডিএফ গ্রহণ করে।

‘ব্রেকিং র‌্যাঙ্কস’–এ সাক্ষাৎকার দেওয়া সৈন্যরা নিশ্চিত করেছেন যে, গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনি বেসামরিকদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ সত্যি। ট্যাঙ্ক কমান্ডার ড্যানিয়েল বলেন, "মানব ঢালকে টানেলের ভেতরে পাঠানো হয়। সে হাঁটতে হাঁটতে পুরো টানেলের মানচিত্র তৈরি করে ফেলে। তার জ্যাকেটে থাকা আইফোন স্বয়ংক্রিয়ভাবে জিপিএস তথ্য পাঠাতে থাকে। কমান্ডাররা দেখলেন এটা কাজ করছে, আর এরপর এই প্রক্রিয়া আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ে। এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রায় প্রতিটি কম্পানির নিজস্ব ‘মানবঢাল’ ছিল।"

তবে আইডিএফ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা কোনোভাবেই বেসামরিক নাগরিকদের মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার বা জোরপূর্বক সামরিক অভিযানে যুক্ত করার অনুমতি দেয় না। তারা আরও জানায়, অভিযোগ পাওয়া গেলে তা বিস্তারিতভাবে তদন্ত করা হয় এবং বেশ কয়েকটি ঘটনায় সামরিক পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত শুরু করেছে, যা এখনো চলমান।

‘স্যাম’ নামের এক কন্ট্রাক্টর, যিনি গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে কাজ করতেন, বলেছেন যে তিনি নিজ চোখে দেখেছেন আইডিএফ নিরস্ত্র বেসামরিকদের হত্যা করছে। একটি ঘটনায় তিনি দেখেন, দুই তরুণ সাহায্য নিতে ছুটে যাচ্ছিল। হঠাৎ দুই সৈন্য দৌড়ে গিয়ে তাদের ওপর গুলি চালায়, যার ফলে ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়। অন্য এক ঘটনায়, সাহায্য বিতরণ কেন্দ্রের কাছে একটি আইডিএফ ট্যাঙ্ক একটি সাধারণ গাড়ি ধ্বংস করে দেয়, যেখানে চারজন নিরস্ত্র মানুষ বসে ছিল।

জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জিএইচএফ-এর সাহায্যকেন্দ্রের আশেপাশে অন্তত ৯৪৪ জন ফিলিস্তিনি বেসামরিক নিহত হয়েছেন সাহায্য নিতে গিয়ে। জিএইচএফ ও আইডিএফ উভয়ই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

আইডিএফ জানায়, বেসামরিক নিহত হওয়ার ঘটনাগুলো নিয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্ত চলছে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য শাস্তি বা আইনি জবাবদিহিতা হয়নি।

প্রামাণ্যচিত্রে দেখা যায়, গাজা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বহু ইসরায়েলি সৈন্যের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছে। ড্যানিয়েল বলেন, "আমি অনুভব করি, তারা আমার ইসরায়েলি হিসেবে গর্বটা ধ্বংস করে দিয়েছে। আইডিএফ অফিসার হিসেবে গর্বটাও। এখন যা বাকি আছে, তা শুধু লজ্জা।"

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান।