সৃষ্টির সেবার মাঝেই স্রষ্টার সন্তুষ্টি নিহিত। ইসলাম শুধু মানুষের অধিকারের কথাই বলে না, বরং আল্লাহর সৃষ্টি হিসেবে পশুপাখির প্রতি দয়া ও সুবিচার প্রদর্শনেরও জোর নির্দেশ দেয়। শখ কিংবা প্রয়োজনে অনেকেই বাড়িতে পশুপাখি পালন করেন। কিন্তু ইসলামে এই প্রতিপালনের রয়েছে সুনির্দিষ্ট কিছু আদব ও মূলনীতি। যথাযথ নিয়ম মেনে পশুপাখি পালন করলে তা যেমন সওয়াবের কাজ, তেমনি অবহেলা করলে তা হতে পারে জাহান্নামের কারণ।
পশুপাখি পালনের ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলামে প্রয়োজন ও উপকারের স্বার্থে পশুপাখি পালন করা বৈধ। নবীজি (সা.)-এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম উট, ঘোড়া, ছাগল ও ভেড়া লালন-পালন করতেন। এমনকি শখের বশে পাখি পালন করার নজিরও হাদিসে পাওয়া যায়। তবে এই বৈধতা শর্তসাপেক্ষ। মূল শর্ত হলো—তাদের অধিকার বা হক যথাযথভাবে আদায় করা।
প্রতিপালনের মূলনীতিসমূহ
পশুপাখি পালনের ক্ষেত্রে একজন মুমিনকে নিচের বিষয়গুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে:
১. নিয়মিত খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ
পশুপাখির ক্ষুধার কষ্ট দেওয়া ইসলামে বড় অপরাধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘এক নারী একটি বিড়ালের কারণে জাহান্নামে গেছে। সে বিড়ালটিকে বেঁধে রেখেছিল। সে নিজেও তাকে খাবার দেয়নি, আবার তাকে ছেড়েও দেয়নি যেন সে জমিনের পোকামাকড় খেয়ে বাঁচতে পারে।’ (বুখারি: ৩৩১৮)
সুতরাং, খাঁচায় বা ঘরে আটকে রাখলে তাদের সময়মতো সুষম খাবার ও পানি দেওয়া মালিকের ওপর ফরজ।
২. সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা না চাপানো
গৃহপালিত পশু দিয়ে কাজ করানোর ক্ষেত্রে তাদের সাধ্যের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। অসুস্থ বা দুর্বল পশুকে দিয়ে কাজ করানো কিংবা অতিরিক্ত বোঝা চাপানো সম্পূর্ণ নিষেধ। একবার নবীজি (সা.) একটি উটের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন, যেটি ক্ষুধার জ্বালায় পিঠের সঙ্গে পেট লেগে গিয়েছিল। তিনি বললেন, ‘এসব বোবা প্রাণীর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো।’ (আবু দাউদ: ২৫৪৮)
৩. মারধর ও কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা
পশুপাখিকে প্রহার করা, মুখে আঘাত করা বা শরীরে কোনো দাগ দেওয়া ইসলামে হারাম। নবীজি (সা.) প্রাণীর মুখে আঘাত করতে নিষেধ করেছেন। এমনকি অহেতুক প্রাণীদের একে অপরের সঙ্গে লড়াই লাগিয়ে দিয়ে তামাশা দেখাও নিষিদ্ধ।
৪. চিকিৎসার ব্যবস্থা করা
মানুষের মতো পশুপাখিও অসুস্থ হয়। মালিক হিসেবে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। তাদের কষ্টে ব্যথিত হওয়া এবং সেবা করা মুমিনের বৈশিষ্ট্য।
৫. মানসিকভাবে কষ্ট না দেওয়া
পশুপাখিরও অনুভূতি আছে। বাচ্চাকে মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা বা তাদের ভয় দেখানো নবীজি (সা.) পছন্দ করতেন না। এক সাহাবি পাখির বাসা থেকে ছানা নিয়ে এলে মা পাখিটি অস্থির হয়ে ডানা ঝাপটাতে থাকে। নবীজি (সা.) তখন নির্দেশ দেন, ‘কে একে তার সন্তান নিয়ে কষ্ট দিল? তার সন্তান তাকে ফিরিয়ে দাও।’ (আবু দাউদ: ২৬৭৫)
কিভাবে পালন করলে সওয়াব হবে?
পশুপাখি পালনের সময় ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি’ ও ‘সৃষ্টির সেবা’র নিয়ত থাকলে প্রতিটি দানায় সওয়াব পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রতিটি সপ্রাণ প্রাণীর সেবায় সওয়াব রয়েছে।’ (বুখারি: ২৩৬৩)
একটি পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করানোর কারণে এক পাপী নারীকে আল্লাহ জান্নাত দান করেছিলেন। আবার কোনো প্রাণীকে কষ্ট দেওয়ার কারণে ইবাদতগুজার ব্যক্তিও জাহান্নামী হতে পারে।
যেসকল প্রাণী পালন করা নিষিদ্ধ
ইসলামে কিছু প্রাণী পালন করা নিরুৎসাহিত বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন—শিকার, ফসল রক্ষা বা পাহারাদারি ছাড়া শুধু শখ করে ঘরে কুকুর পালন করা ইসলামে অনুমোদিত নয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শিকার করা বা গবাদিপশু পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন ছাড়া কুকুর পালে, তার আমলনামা থেকে প্রতিদিন দুই কিরাত পরিমাণ নেকি কমে যায়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
পশুপাখি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। শখের বশে বা প্রয়োজনে এদের পালন করলে অবশ্যই তাদের প্রতি সদয় হতে হবে। অবলা প্রাণীর প্রতি আমাদের আচরণই নির্ধারণ করে দিতে পারে আমাদের পরকালের গন্তব্য। তাই আসুন, পশুপাখির প্রতি যত্নশীল হই এবং আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি দয়া প্রদর্শন করে তাঁর দয়া ও ভালোবাসা অর্জন করি।




Comments