Image description

চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র এক সপ্তাহ বাকি—এ অবস্থায় পরাজয় ঠেকাতে মরিয়া হয়ে ওঠে পাকিস্তান। তাদের মিত্রশক্তিও সর্বোচ্চ চেষ্টা চালায় যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব জাতিসংঘে পাশ করানোর জন্য। কিন্তু ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর, যখন দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব শহরই মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে, তখন নিরাপত্তা পরিষদে আবারও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তোলা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোয় সেই প্রস্তাবও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়।

১৯৭১ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও চীন যুদ্ধবিরতির জন্য চাপ সৃষ্টি করলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতকে সমর্থন দিয়ে প্রস্তাবে ভেটো দেয়। যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ায় পাকিস্তান কূটনৈতিকভাবে আরও কোণঠাসা হয়। তবে পাকিস্তানকে সমর্থন করে শক্ত অবস্থান নেন তৎকালীন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি জর্জ বুশ (পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট)।

১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মিশন প্রধান হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বলেন, 'আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই ঢাকা মুক্ত হবে। ঢাকার পতনের মধ্য দিয়ে আমাদের মাতৃভূমি হানাদার শত্রুদের কবল থেকে মুক্ত হবে। বাংলাদেশ মুক্ত হলেই মুক্তিবাহিনী থেমে যাবে না। পাকিস্তান যদি ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ প্রত্যাহার না করে তবে আমাদের মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় জওয়ানেরা পশ্চিম পাকিস্তানেও যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।'

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, 'আজকের এই দিনে আমি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর প্রতিও গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আমি বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ জনগণ এবং আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি অভিনন্দন জানাই। ইয়াহিয়া খান আমাদের নেতাকে জেলে রাখলে তার মন আমাদের মধ্যে এবং আমাদের মন তার মধ্যে পড়ে রয়েছে। বিশ্বের কোনো শক্তিই তা ধ্বংস করতে পারবে না।'

একই দিনে লোকসভার অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, 'জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যুদ্ধ বিরতি এবং সৈন্য অপসারণের জন্য জাতিসংঘ যে অবাস্তব প্রস্তাব দিয়েছে ভারত তাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আমরা জাতীয় উদ্দেশ্য পূরণের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছি। এতদিন আমাদের ওপর আঘাত এসেছে, এবার আমরাও পাল্টা আঘাত করছি।'

এদিকে রাওয়ালপিণ্ডিতে রেডিও পাকিস্তানে দেওয়া এক ভাষণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন বলেন, 'ভারতীয় বাহিনী ও ভারতীয় চরদের সব আক্রমণ নস্যাৎ করে দিতে হবে। ভারতীয় ষড়যন্ত্রের কারণে আজ পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ জীবন নিয়ে শঙ্কিত। অথচ জাতিসংঘ এখন সার্কাসের পুতুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তানকে আজ বাঁচাতে হলে সাধারণ মানুষকে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। আজ আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এসেছে।  

মার্কিন অবস্থান:
যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামরিক-রাজনৈতিকভাবে সমর্থন করলেও যুদ্ধ দ্রুত ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় তাদের প্রভাব কমতে থাকে। মার্কিন সপ্তম নৌবহর (৭th Fleet) ভারত মহাসাগরের দিকে নড়াচড়া শুরু করে—যা ছিল একটি মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি করার কৌশল।

সোভিয়েত সমর্থন: 
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায় এবং কূটনৈতিকভাবে প্রতিটি প্রস্তাবে পাকিস্তানবিরোধী আবহ বজায় রাখে। সোভিয়েত নৌবাহিনীও ভারত মহাসাগরে উপস্থিতি বৃদ্ধি করে—যা শীতল যুদ্ধকে আরও তীব্র করে তোলে। 

যুক্তরাজ্যের অবস্থান: 
ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ থাকলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চাপে পড়ে। বহু ব্রিটিশ সংসদ সদস্য প্রকাশ্যে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন।

তবে ৯ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন বলেন, 'উপমহাদেশের আজকের পরিস্থিতির জন্য ভারত দায়ী নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভারতকে দায়ী করে দেওয়া অভিমত সম্পূর্ণ মিথ্যা। পূর্ব বাংলার আজকের পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তানই দায়ী। তারাই বৈষম্য, নিপীড়নের মাধ্যমে আজকের পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে।'

চীন সমর্থন:
চীন পাকিস্তানের প্রতি কূটনৈতিক সমর্থন ধরে রাখলেও সামরিকভাবে সহায়তা করার মতো অবস্থানে ছিল না। 

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবেদন:  
নিউ ইয়র্ক টাইমস, টাইম ম্যাগাজিন, দ্য গার্ডিয়ানসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, ধর্ষণ ও দমননীতি নিয়ে বড় রিপোর্ট প্রকাশ করে। পশ্চিমা বিশ্বের সাধারণ মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকে। 
লন্ডন, নিউ ইয়র্ক ও প্যারিসে পাকিস্তানবিরোধী বিক্ষোভ হয়। 

শরণার্থী সংকট নাড়া দেয় বিশ্বকে:
ভারতের আশ্রয় শিবিরে প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দুর্ভোগ আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO), ইউনিসেফসহ বিভিন্ন সংস্থা জরুরি চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা বাড়ায়।

এই দিনে বিভিন্ন ফ্রন্টে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী বড় ধরনের সাফল্য অর্জন করে। উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো হলো;

মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, এবং কুমিল্লা অঞ্চলে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। বহু স্থানে পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরক্ষার অবস্থান হারিয়ে পিছু হটতে থাকে।

টাঙ্গাইল অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় প্যারা ট্রুপারদের যৌথ অভিযান (“টাঙ্গাইল ড্রপ”) সফল হওয়ায় ঢাকার দিকে অগ্রযাত্রা আরও ত্বরান্বিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর ঢাকা রক্ষার পথ উল্লেখযোগ্যভাবে সংকুচিত হয়।

পূর্ব পাকিস্তানে বিপুল এলাকা মুক্ত হওয়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়তে থাকে। কিছু স্থানে পাকিস্তানি সেনারা গণহারে আত্মসমর্পণ শুরু করে।