সাম্প্রতিক সময়ে ঘন ঘন ভূমিকম্পের ঘটনায় জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞানের মতে, টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়ার কারণে ভূমিকম্প হয়। তবে ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পেছনে রয়েছে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক কারণ। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) চৌদ্দশ বছর আগেই ভূমিকম্প বেড়ে যাওয়া সম্পর্কে উম্মতকে সতর্ক করেছিলেন এবং এর কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন।
কিয়ামতের অন্যতম আলামত
রাসুলুল্লাহ (সা.) ভূমিকম্পের আধিক্যকে কিয়ামতের অন্যতম আলামত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, “ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবে না, যতক্ষণ না ইলম (ধর্মীয় জ্ঞান) উঠিয়ে নেওয়া হবে এবং অধিক পরিমাণে ভূমিকম্প হবে।” (সহিহ বুখারি: ১০৩৬)
অর্থাৎ, শেষ জামানায় মানুষের পাপাচার যখন বেড়ে যাবে, তখন মহান আল্লাহ সতর্কবার্তা হিসেবে জমিনে কম্পন সৃষ্টি করবেন।
ভূমিকম্প কেন হয়? হাদিসের সতর্কবার্তা
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন পাপাচার ঢুকে পড়ে, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব হিসেবে ভূমিকম্প বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে। তিরমিজি শরীফের একটি দীর্ঘ হাদিসে রাসুল (সা.) ১৫টি পাপাচারের কথা উল্লেখ করেছেন, যা সমাজে ছড়িয়ে পড়লে ভূমিকম্প, ভূমিধস ও রূপ বিকৃতির মতো ঘটনা ঘটবে।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ হলো—
১. যখন গনিমতের মাল (রাষ্ট্রীয় সম্পদ) ব্যক্তিগত সম্পদ হিসেবে ভোগ করা হবে।
২. আমানতের খিয়ানত করা হবে।
৩. জাকাত দেওয়াকে বোঝা মনে করা হবে।
৪. পুরুষরা স্ত্রীর আনুগত্য করবে কিন্তু মায়ের অবাধ্য হবে।
৫. বন্ধুদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে কিন্তু বাবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করবে।
৬. মসজিদে উচ্চস্বরে শোরগোল হবে।
৭. পাপাচারী ও নিকৃষ্ট ব্যক্তিরা সমাজের নেতা হবে।
৮. গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন ব্যাপক হারে বেড়ে যাবে।
৯. মদ্যপান ছড়িয়ে পড়বে।
রাসুল (সা.)-এর এই সতর্কবাণী বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে সহজেই মিলিয়ে নেওয়া যায়। অশ্লীলতা, বেহায়াপনা এবং অন্যায়ের প্রাবল্যই মূলত এই বিপর্যয়ের মূল কারণ।
এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা
ভূমিকম্প শুধুই একটি প্রাকৃতিক ঘটনা নয়, বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দাদের জন্য এক কঠোর হুঁশিয়ারি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি ভয় দেখানোর জন্যই (তাদের কাছে) নিদর্শনগুলো পাঠাই।” (সূরা বনি ইসরাইল: ৫৯)
হযরত উমর (রা.)-এর শাসনামলে একবার মদিনায় ভূমিকম্প হলো। তিনি তখন জনগণকে উদ্দেশ্য করে ভাষণ দিলেন, “হে মদিনাবাসী! তোমরা কী এমন কাজ করেছ? যার কারণে এই কম্পন? আল্লাহর কসম! যদি আবারও ভূমিকম্প হয়, তবে আমি আর তোমাদের সঙ্গে এই শহরে থাকব না।” (ইবনুল কাইয়িম)
অর্থাৎ, সাহাবায়ে কেরামও ভূমিকম্পকে পাপাচারের ফল মনে করতেন।
ভূমিকম্পের সময় মুমিনের করণীয়
ভূমিকম্প শুরু হলে আতঙ্কিত না হয়ে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা এবং কিছু আমল করা উচিত। সুন্নাহর আলোকে করণীয়গুলো হলো—
তাওবা ও ইস্তেগফার করা: তাৎক্ষণিকভাবে আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহের জন্য ক্ষমা চাওয়া। রাসুল (সা.) দুর্যোগের সময় বেশি বেশি ইস্তেগফার করতে বলেছেন।
দান-সদকা করা: রাসুল (সা.) বলেছেন, “নিশ্চয়ই সদকা আল্লাহর রাগ প্রশমিত করে এবং অপমৃত্যু রোধ করে।” (তিরমিজি)
ধৈর্য ধারণ ও দোয়া করা: আতঙ্কিত হয়ে ছোটাছুটি না করে মহান আল্লাহর জিকির করা এবং নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা।
নামাজে দাঁড়িয়ে যাওয়া: দুর্যোগ বা ভয়ের সময় রাসুল (সা.) মসজিদে গিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন।
ভূমিকম্প আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, এই পৃথিবী ক্ষণস্থায়ী এবং মহান আল্লাহর শক্তি অসীম। তাই এই সতর্কবার্তা পেয়ে আমাদের উচিত পাপাচার ছেড়ে সৎপথে ফিরে আসা এবং আল্লাহর কাছে নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করা। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন, আমীন।




Comments