Image description

ইসলামি সমাজব্যবস্থায় পারস্পরিক বিশ্বাস, সম্মান এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখা অন্যতম প্রধান ইবাদত। কিন্তু বর্তমান সময়ে আমাদের সামাজিক মজলিশগুলোর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে 'গিবত' বা পরনিন্দা। কারও অনুপস্থিতিতে তার এমন কোনো ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা, যা শুনলে সে মনে কষ্ট পাবে—ইসলামি শরিয়তে একেই বলা হয় গিবত।

পবিত্র কুরআনের হুঁশিয়ারি
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে গিবতকে একটি অরুচিকর ও বীভৎস কাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সুরা হুজুরাতের ১২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন:

“তোমাদের কেউ যেন কারও গিবত না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? নিশ্চয়ই তোমরা তা অপছন্দ করবে। সুতরাং তোমরা আল্লাহকে ভয় করো।”

এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, গিবত করা আর নিজের মৃত ভাইয়ের কাঁচা গোশত খাওয়া সমান অপরাধ। মানুষের সম্মান তার রক্তের মতোই পবিত্র, আর গিবত হলো সেই সম্মানে আঘাত হানা।

রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর বর্ণনায় গিবতের শাস্তি
গিবতকারীর জন্য পরকালে অত্যন্ত ভয়ানক আজাবের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে:

তামার নখ দিয়ে মুখমণ্ডল আঁচড়ানো: মিরাজেন রাতে রাসূলুল্লাহ (সা.) এমন কিছু লোককে দেখতে পান, যাদের নখগুলো ছিল তামার। তারা সেই নখ দিয়ে নিজেদের মুখমণ্ডল ও বুক আঁচড়াচ্ছিল। জিবরাঈল (আ.)-কে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, এরা সেই লোক যারা মানুষের অনুপস্থিতিতে তাদের সম্মানহানি করত এবং গিবত করত। (আবু দাউদ)।

ব্যভিচারের চেয়েও মারাত্মক: কোনো কোনো হাদিসে গিবতকে ব্যভিচারের চেয়েও গুরুতর বলা হয়েছে। কারণ ব্যভিচারী তওবা করলে আল্লাহ মাফ করে দিতে পারেন, কিন্তু গিবতকারীকে ততক্ষণ মাফ করা হয় না, যতক্ষণ না যার নামে গিবত করা হয়েছে সে তাকে ক্ষমা করে।

আমলনামা শূন্য হওয়া: কিয়ামতের দিন গিবতকারী ব্যক্তি ‘দেউলিয়া’ হিসেবে সাব্যস্ত হবে। তার নেকিগুলো সেই ব্যক্তির আমলনামায় চলে যাবে যার সে গিবত করেছিল। যদি তার নেকি শেষ হয়ে যায়, তবে যার গিবত করেছিল তার গুনাহগুলো গিবতকারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।

গিবত কেন সামাজিক ক্যানসার?
গিবত কেবল পরকালের শাস্তিই বয়ে আনে না, এটি দুনিয়াতেও অশান্তির মূল কারণ। গিবতের ফলে:

  • মানুষের মধ্যে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়ে।

  • একজনের প্রতি অন্যজনের বিশ্বাস নষ্ট হয়।

  • সামাজিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ ধুলোয় মিশে যায়।

  • ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ও সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়।

গিবত থেকে বাঁচার উপায়
ইসলামি চিন্তাবিদগণ গিবত থেকে বাঁচতে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলেন:
জিহ্বা নিয়ন্ত্রণ: রাসূল (সা.) বলেছেন, "যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালের ওপর বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে।"
মজলিশ ত্যাগ করা: কোথাও গিবত শুরু হলে তা বন্ধ করার চেষ্টা করা, নতুবা সেখান থেকে উঠে আসা মুমিনের দায়িত্ব।
নিজের ত্রুটি খোঁজা: অন্যের সমালোচনা করার আগে নিজের ভুলগুলো নিয়ে চিন্তা করলে গিবত করার আগ্রহ কমে যায়।

তওবা ও প্রতিকার
যদি কেউ ইতিপূর্বে গিবত করে থাকেন, তবে এর প্রতিকারের পথও ইসলাম বলে দিয়েছে। প্রথমত, আল্লাহর কাছে খাঁটি মনে তওবা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সম্ভব হলে যার গিবত করা হয়েছে তার কাছে সরাসরি ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। যদি সরাসরি ক্ষমা চাওয়া সম্ভব না হয় (যেমন—সে মারা গিয়ে থাকলে বা ক্ষমা চাইলে ফিতনা সৃষ্টির আশঙ্কা থাকলে), তবে তার জন্য আল্লাহর কাছে প্রাণভরে দোয়া ও ইস্তেগফার করতে হবে।

গিবত একটি আত্মঘাতী পাপ। এটি মানুষের তিল তিল করে জমানো নেক আমলগুলোকে নিমিষেই পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। তাই পরকালের কঠিন আজাব থেকে বাঁচতে এবং সুন্দর সমাজ গড়তে আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজের জিহ্বাকে হেফাজত করা এবং অন্যের অগোচরে তার সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকা।